Thursday , November 7 2024

জুলাইবিব রাঃ এর বিপ্লবী জীবন

সেই চৌদ্দ শ’ বছর আগেকার সময়। চারপাশে বংশ, গোষ্ঠী আর ক্ষমতার দ্বন্ধ। যার বংশ যতো সমৃদ্ধ, যতো মর্যাদাসম্পন্ন, নের্তৃত্ব আর অহংকারের বড়াই তার ততো বেশি। বংশ মর্যাদার প্রতাপ আর ক্ষমতার জোর সেখানে এতো বেশি প্রগাঢ় ছিলো যে— নিঁচু বংশের কিংবা অপ্রসিদ্ধ বংশের কারো সাথে সেই সময়ে সম্পর্ক পাতানোটাই ছিলো রীতিমতো মানহানিকর ব্যাপার।

এমন একটা সময়ে, এমন একটা সমাজে যদি কারো বংশের নাম-নিশানাও না পাওয়া যায়? যদি না-ই জানা যায় যে, সে কোন বংশের, কিংবা অজ্ঞাত থেকে যায় তার বংশ পরম্পরা— তার ব্যাপারে সমাজের চাহনি আর আচরণ কেমন হবে, তা কি অনুমেয় নয়?

হ্যাঁ, এমন একজন সাহাবি হলেন জুলাইবিব রাদিয়াল্লাহু আনহু। অন্য অনেক সাহাবির মতোন তিনি খুব বেশি আলোচিত নন। জুলাইবিব শব্দের অর্থ হলো— যে অনেক বেশি খাঁটো। তার শারীরিক গড়ন স্বাভাবিকের তুলনায় খাঁটো হওয়াতে তার নামই হয়ে যায় জুলাইবিব। কেবল খাঁটোই নন, তার গায়ের রঙ ছিলো কুচকুচে কালো। একে তো বংশ পরম্পরা অজানা, তার উপর আবার খাঁটো আর কালচে গাত্র বর্ণ— সব মিলিয়ে ওই সমাজের কাছে তিনি যে ব্রাত্য আর অবাঞ্চিত থাকবেন— তা তো বলাই বাহুল্য।

জুলাইবিব রাদিয়াল্লাহু আনহুকে কেউই পছন্দ করতো না। বংশ মর্যাদা নেই, কালচে গায়ের রঙ, কৃশকায় শরীর, এমন একজন লোকের সাথে ওই সমাজে কেউ মেয়ে বিয়ে দেবে— তা কি কল্পনাতেও ভাবা যায়? কিন্তু, জুলাইবিব রাদিয়াল্লাহু আনহুর যে বড্ড সংসার পাতানোর শখ।

একদিন, এক প্রশস্ত বিকেলে, খুব মন খারাপ করে নবিজী সাল্লাললাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে এলেন জুলাইবিব রাদিয়াল্লাহু আনহু। এই একটা মানুষের কাছে এসেই তিনি শান্তি পান। দু’দন্ড সুখ-দুঃখের কথা বলতে পারেন। নবিজী ব্যতীত, এই তল্লাটে জুলাইবিবের আর কোন বন্ধু নেই। নবিজীর পাশে বসে, ওই আদিগন্ত নীল আকাশের দিকে তাকিয়ে তিনি বললেন, ‘আচ্ছা ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমি যদি জান্নাতে যেতে পারি, তাহলে কি আমি জান্নাতের হুর বিয়ে করতে পারবো?’

নবিজী আঁচ করতে পারলেন জুলাইবিবের মর্মযাতনা। অন্তরের গহীনে সংসার পাতানোর যে অদম্য শখ জুলাইবিবের, সেই শখ থেকেই যে এমন হাহাকার করা প্রশ্নের আবির্ভাব— তা নবিজী ধরে ফেললেন। তিনি বললেন, ‘জুলাইবিব, আমি কি তোমার বিয়ের ব্যবস্থা করবো?’ নবিজীর কথা শুনে আনন্দে নেচে উঠলো জুলাইবিবের মন। এরচেয়ে স্বস্তিদায়ক কোন কথা জুলাইবিব রাদিয়াল্লাহু আনহু কি এর আগে কখনো শুনেছেন? এরচেয়ে তৃপ্তিদায়ক কোন আশার আলো কখনো কি তার সামনে প্রতিভাত হয়েছিলো? নবিজীর দিকে অপলক তাকিয়ে থাকলেন জুলাইবিব রাদিয়াল্লাহু আনহু। তার চোখেমুখে মুগ্ধতার অপার বিস্ময়!

ঠিক ঠিক নবিজী জুলাইবিবের বিয়ের বন্দোবস্তের তোড়জোড় আরম্ভ করলেন। এক আনসারী সাহাবিকে ডেকে বললেন, ‘তোমার কন্যাকে কি বিয়ে দেবে?’

আনন্দের আতিশয্যে উৎফুল্ল হয়ে আনসারী সাহাবি বললেন, ‘সুবহানআল্লাহ! ইয়া রাসূলাল্লাহ, আপনার কাছে কন্যা বিয়ে দিতে পারবো, এরচাইতে মহা সৌভাগ্যের ব্যাপার আমার জন্য আর কি হতে পারে?’

নবিজী বললেন, ‘না, আমি আমার জন্যে বলিনি’। একটু থতমত খেলেন যেন আনসারী সাহাবি। বললেন, ‘তাহলে, ইয়া রাসূলাল্লাহ?’ নবিজী বললেন, ‘জুলাইবিবের জন্য’।

জুলাইবিব! তাকে কে না চেনে? দেখতে অসুন্দর, কৃশকায় শরীর, বংশ-মর্যাদাহীন এই মানুষটাকে চেনে না, এমন মানুষ এই তল্লাটে দেখা মেলা ভার! তার কিছুই নেই। আনসারী সাহাবি বললেন, ‘ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমি আমার স্ত্রীর সাথে একটু পরামর্শ করতে চাই এই ব্যাপারে। আপনি আমাকে একটু সময় দিন’। স্ত্রীর কাছে এসে আনসারী সাহাবি বললেন, ‘শুনছো, নবিজী আমাদের কন্যাকে বিয়ের জন্য চাইছেন’। ‘সুবহানআল্লাহ! এটা তো ভারি আনন্দের সংবাদ। নবিজী আমাদের কন্যাকে বিয়ে করবেন, এ তো মহাখুশির ব্যাপার’। আনসারী সাহাবি বললেন, ‘না, নবিজী নিজের জন্য প্রস্তাব করেন নি’। -‘তাহলে?’ -‘তিনি জুলাইবিবের জন্য চেয়েছেন আমাদের কন্যাকে’।

মহিলা তার অভিমত ব্যক্ত করলেন। বললেন, ‘নবিজীকে বলুন, জুলাইবিবের কাছে আমরা আমাদের কন্যাকে বিয়ে দিতে পারবো না’। স্ত্রীর অভিমত শুনে নবিজী সাল্লাললাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের উদ্দেশ্যে গৃহের বাইরে পা বাড়ালেন আনসারী সাহাবি। হঠাৎ, গৃহের অভ্যন্তর থেকে একটি কোমল, অথচ দৃঢ় কন্ঠস্বর ভেসে এলো বাতাসে। -‘আব্বা’। থমকে দাঁড়ালেন আনসারী সাহাবি। তিনি জবাবে বললেন, ‘বলো, আমার কন্যা’। মেয়েটি বিনীত গলায় বললো, ‘আমার বিয়ের ব্যাপারেই কি কথা হচ্ছিলো?’ -‘হ্যাঁ’। -‘কোথাকার প্রস্তাব?’ -‘নবিজী সাল্লাললাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পাঠিয়েছেন। তিনি তোমাকে জুলাইবিবের জন্য প্রস্তাব করেছেন’। বিস্ময়ের সাথে মেয়েটি বলে উঠলো, ‘সুবহানআল্লাহ। আপনাদের কি মত এতে?’

-‘তোমার আম্মা রাজি নেই। জুলাইবিবের সাথে তোমার আম্মা তোমাকে বিয়ে দিতে কিছুতেই ইচ্ছুক নয়। এই সংবাদ নবিজীকে দেওয়ার জন্যই আমি তার কাছে যাচ্ছি’।

মেয়েটি বললো, ‘আব্বা, কার প্রস্তাব আপনারা ফিরিয়ে দিতে যাচ্ছেন সে ব্যাপারে আপনাদের কোন ধারণা আছে? আল্লাহর রাসূলের পাঠানো প্রস্তাবকে আপনারা অপছন্দ করছেন কিভাবে? আপনারা কি কুরআনের এই আয়াত শোনেন নি, যেখানে বলা হচ্ছে, ‘আল্লাহ ও তার রাসূল কোন ব্যাপারে নির্দেশ দিলে, কোন মুমিন পুরুষ ও নারীর উচিত নয় তা ব্যতীত নিজেদের জন্য অন্য কোনোকিছু চিন্তা করা। আর, যে আল্লাহ ও তার রাসূলকে অমান্য করলো, সে স্পষ্টই পথভ্রষ্ট হবে’। [১]

আব্বা, নবিজীর পাঠানো প্রস্তাবের ব্যাপারে আমার কোনোই দ্বিমত নেই। তিনি নিশ্চয় আমার জন্য অকল্যাণকর কোনোকিছু চাইবেন না। আমি সন্তুষ্টচিত্তে এই প্রস্তাবে রাজি আছি। আপনি দয়া করে আমাকে নবিজীর কাছে নিয়ে চলুন এবং তাকে বলুন তিনি যেন আমার বিয়ের ব্যবস্থা করেন’। দুরন্ত সাহসের এই রমণীর সাথেই নবিজী জুলাইবিব রাদিয়াল্লাহু আনহুর বিয়ে দেন।

বিয়ে হলো। বাসর সাজানো হলো। এরপর ডাক এলো জিহাদের। শত্রুর বিরুদ্ধে সম্মুখ লড়াই। যুদ্ধের জন্য রণ সাজে সজ্জিত মুসলিম বাহিনী। প্রস্তুত জুলাইবিব রাদিয়াল্লাহু আনহুও। ময়দানে, নির্ধারিত সময়েই শুরু হলো শত্রুবাহিনীর বিরুদ্ধে মুসলিম বাহিনীর মুখোমুখি যুদ্ধ। মরছে শত্রু, শাহাদাতের অমিয় পেয়ালা বরণ করে নিচ্ছে মুসলিম যোদ্ধারাও। একপর্যায়ে, অবসান হলো সবকিছুর। স্থবিরতার ছায়া নেমে এলো রণাঙ্গনে।এখানে-ওখানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে শত্রুপক্ষ আর মুসলিম বাহিনীর অনেকের লাশ। নিজ নিজ আপনজন, আত্মীয়-স্বজনদের খুঁজে নিচ্ছে অনেকেই। নবিজী সাহাবিদের উদ্দেশ্য করে বললেন, ‘তোমরা কাকে কাকে হারিয়েছো?’ তারা বললেন, ‘ইয়া রাসূলাল্লল্লাহ! আমরা অমুক অমুককে হারিয়েছি’। তিনি আরেকদল সাহাবিদের উদ্দেশ্য করে বললেন, ‘তোমরা কাকে কাকে হারিয়েছো?’ তারা বললেন, ‘আমরা অমুক অমুককে হারিয়েছি, ইয়া রাসুলাল্লাহ’।

তখন, বিষণ্ণ চেহারায় নবিজী বললেন, ‘আমি হারিয়েছি আমার জুলাইবিবকে’। চারদিকে খোঁজা শুরু হলো। কোথায় আছে জুলাইবিব? খুঁজতে খুঁজতে, একটা কূপের কাছে পাওয়া গেলো জুলাইবিবের লাশ। শাহাদাতের পেয়ালা পান করে, অনন্ত জীবনের পানে উড়াল দিয়েছেন এই মহান সাহাবি। অশ্রু-ভরা নয়নে নবিজী জুলাইবিবের লাশের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘নিশ্চয়, আমি জুলাইবিবের জন্য, আর জুলাইবিব আমার জন্য’। দুনিয়ায় সংসার পাতানোর স্বপ্নকে অসম্ভব দেখে, একদিন খুব মন খারাপ করে জুলাইবিব রাদিয়াল্লাহু আনহু নবিজীকে বলেছিলেন, ‘আচ্ছা ইয়া রাসুলাল্লাহ! আমি যদি জান্নাতে যেতে পারি, তাহলে কি আমি জান্নাতের হুর বিয়ে করতে পারবো?’ জুলাইবিবের লাশকে সামনে রেখে, সেদিন নবিজী বলেছিলেন, ‘জুলাইবিব, তুমি নিশ্চয় তোমার কাঙ্খিত সঙ্গিনীকে পেয়ে গেছো’। বংশ-মর্যাদা নেই, কৃষ্ণকায় গাত্রবর্ণ আর কৃশকায় শরীরের জন্য যে জুলাইবিব সমাজের সর্বত্র অবাঞ্চিত আর ব্রাত্য হয়ে ছিলেন— নবিজীর কাছে তার কী অপার মর্যাদা! যার কথা শুনলে সকলে ভ্রুকুঞ্চিত করে ফেলতো, তার জন্যে মুহাম্মাদ সাল্লাললাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বুকের ভেতর থেকে উজাড় করেছেন কী অসামান্য ভালোবাসা! এই যে নিরেট বাস্তব আর স্বার্থহীন ভালোবাসা— এই ভালোবাসা তো এমন মহা মানবের হৃদয়ের গহীন থেকেই উৎসারিত হওয়া সম্ভব।

About Md Nazmul Azam

I am website developer.

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *