Friday , July 11 2025

সূরা তাওবা আয়াত ৩৮-৪২ এর দারস (তাফসীর)

সূরা আত তাওবা আয়াত- ৩৮-৪২

یٰۤاَیُّهَا الَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡا مَا لَكُمۡ اِذَا قِیۡلَ لَكُمُ انۡفِرُوۡا فِیۡ سَبِیۡلِ اللّٰهِ اثَّاقَلۡتُمۡ اِلَی الۡاَرۡضِ ؕ اَرَضِیۡتُمۡ بِالۡحَیٰوۃِ الدُّنۡیَا مِنَ الۡاٰخِرَۃِ ۚ فَمَا مَتَاعُ الۡحَیٰوۃِ الدُّنۡیَا فِی الۡاٰخِرَۃِ اِلَّا قَلِیۡلٌ ﴿۳۸﴾

اِلَّا تَنۡفِرُوۡا یُعَذِّبۡكُمۡ عَذَابًا اَلِیۡمًا ۬ۙ وَّ یَسۡتَبۡدِلۡ قَوۡمًا غَیۡرَكُمۡ وَ لَا تَضُرُّوۡهُ شَیۡئًا ؕ وَ اللّٰهُ عَلٰی كُلِّ شَیۡءٍ قَدِیۡرٌ ﴿۳۹﴾

اِلَّا تَنۡصُرُوۡهُ فَقَدۡ نَصَرَهُ اللّٰهُ اِذۡ اَخۡرَجَهُ الَّذِیۡنَ كَفَرُوۡا ثَانِیَ اثۡنَیۡنِ اِذۡ هُمَا فِی الۡغَارِ اِذۡ یَقُوۡلُ لِصَاحِبِهٖ لَا تَحۡزَنۡ اِنَّ اللّٰهَ مَعَنَا ۚ فَاَنۡزَلَ اللّٰهُ سَكِیۡنَتَهٗ عَلَیۡهِ وَ اَیَّدَهٗ بِجُنُوۡدٍ لَّمۡ تَرَوۡهَا وَ جَعَلَ كَلِمَۃَ الَّذِیۡنَ كَفَرُوا السُّفۡلٰی ؕ وَ كَلِمَۃُ اللّٰهِ هِیَ الۡعُلۡیَا ؕ وَ اللّٰهُ عَزِیۡزٌ حَكِیۡمٌ ﴿۴۰﴾

اِنۡفِرُوۡا خِفَافًا وَّ ثِقَالًا وَّ جَاهِدُوۡا بِاَمۡوَالِكُمۡ وَ اَنۡفُسِكُمۡ فِیۡ سَبِیۡلِ اللّٰهِ ؕ ذٰلِكُمۡ خَیۡرٌ لَّكُمۡ اِنۡ كُنۡتُمۡ تَعۡلَمُوۡنَ ﴿۴۱﴾

لَوۡ كَانَ عَرَضًا قَرِیۡبًا وَّ سَفَرًا قَاصِدًا لَّاتَّبَعُوۡكَ وَ لٰكِنۡۢ بَعُدَتۡ عَلَیۡهِمُ الشُّقَّۃُ ؕ وَ سَیَحۡلِفُوۡنَ بِاللّٰهِ لَوِ اسۡتَطَعۡنَا لَخَرَجۡنَا مَعَكُمۡ ۚ یُهۡلِكُوۡنَ اَنۡفُسَهُمۡ ۚ وَ اللّٰهُ یَعۡلَمُ اِنَّهُمۡ لَكٰذِبُوۡنَ ﴿۴۲﴾

৩৮। হে ঈমানদারগগণ! তোমাদের কি হল যে, যখন তোমাদেরকে আল্লাহর পথে অভিযানে বের হতে বলা হয়, তখন তোমরা ভারাক্রান্ত হয়ে যমীনে ঝুঁকে পড়? তোমরা কি আখেরাতের পরিবর্তে দুনিয়ার জীবনে পরিতুষ্ট হয়েছ? আখেরাতের তুলনায় দুনিয়ার জীবনের ভোগের উপকরণ তো নগণ্য।

৩৯। যদি তোমরা অভিযানে বের না হও, তবে তিনি তোমাদেরকে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি দেবেন এবং অন্য জাতিকে তোমাদের পরিবর্তে আনয়ন করবেন এবং তোমরা তার কোনই ক্ষতি করতে পারবে না। আর আল্লাহ্ সব কিছুর উপর ক্ষমতাবান।

৪০। যদি তোমরা তাকে সাহায্য না কর, তবে আল্লাহ তো তাকে সাহায্য করেছিলেন যখন কাফেররা তাকে বহিস্কার করেছিল এবং তিনি ছিলেন দুজনের দ্বিতীয়জন, যখন তারা উভয়ে গুহর মধ্যে ছিল; তিনি তখন তার সঙ্গীকে বলেছিলেন, বিষন্ন হয়ে না, আল্লাহ তো আমাদের সাথে আছেন। অতঃপর আল্লাহ তার উপর তার প্রশান্তি নাযিল করেন এবং তাকে শক্তিশালী করেন এমন এক সৈন্যবাহিনী দ্বারা যা তোমরা দেখনি এবং তিনি কাফেরদের কথা হেয় করেন। আর আল্লাহর কথাই সমুন্নত এবং আল্লাহ পরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময়।

৪১। অভিযানে বের হয়ে পড়, হালকা অবস্থায় হোক বা ভারি অবস্থায় এবং জিহাদ কর আল্লাহ্র পথে তোমাদের সম্পদ ও জীবন দ্বারা। এটাই তোমাদের জন্য উত্তম, যদি তোমরা জানতে!

৪২। যদি সহজে সম্পদ লাভের আশা থাকত ও সফর সহজ হত তবে তারা অবশ্যই আপনার অনুসরণ করত, কিন্তু তাদের কাছে যাত্রাপথ সুদীর্ঘ মনে হল। আর অচিরেই তারা আল্লাহর নামে শপথ করে বলবে, পারলে আমরা নিশ্চয়ই তোমাদের সাথে বের হতাম। তারা তাদের নিজেদেরকেই ধ্বংস করে। আর আল্লাহ জানেন নিশ্চয় তারা মিথ্যাবাদী।

নামকরণ :

এই সুরার দু’টি নাম। এক. তওবা, দুই. বারায়াত। তওবা নামকরণ এই কারণে যে কতিপয় ঈমানদারের তবুক যুদ্ধে শরীক না হওয়ার জন্য যে গুনাহ হয়েছিল এই সুরায় তাদের তওবা কবুল করে ক্ষমা করার কথা উল্লেখ রয়েছে। আর বারায়াত (সম্পর্কচ্ছেদ) এই অর্থে যে সুরার শুরুতে মুশরিকদের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করার কথা বলা হয়েছে।

বিসমিল্লাহ না লেখা :

এই সুরার শুরুতে বিসমিল্লাহির রহমানির রহিম লেখা হয়নি। না লেখার কারণ প্রসঙ্গে নানাজনে নানা কথা বলেছেন। তবে ইমাম রাজী রহ.-এর বক্তব্যই সঠিক। তিনি বলেছেন, নবি মুহাম্মদ সা. এই সুরার শুরুতে বিসমিল্লাহির রহমানির রহিম লেখেননি, তাই সাহাবায়ে কেরামও লেখেননি এবং পরবর্তীকালে সবাই এই রীতি অবলম্বন করেছেন। বর্তমান কুরআন যে হুবুহু মুহাম্মদ সা. থেকে এবং কোনোরূপ পরিবর্তন ছাড়াই আমাদের হাতে এসেছে এটি একটি বাড়তি প্রমাণ।

নাজিলের সময়কাল :

এই সুরা তিনটি ভাষণের সমষ্টি। প্রথম থেকে পঞ্চম রুকু পর্যন্ত ৯ম হিজরির জিলকদ মাস বা কাছাকাছি সময় নাজিল হয়। নবি সা. সে বছর হজরত আবু বকর রা.-কে আমিরুল হজ করে মক্কায় পাঠানোর পরে এই ভাষণটি নাজিল হয়। নাজিলের সংগে সংগে নবি সা. আলী রা.-কে এই ভাষণটিসহ পাঠান যাতে হজে আগত লোকদের সম্মুখে পেশ করতে পারেন। তখনো আরবের মুশরিকরা হজ করতে পারতো এবং তারা উলঙ্গ হয়ে হজ করতো। হজের মহাসমাবেশে এই ভাষণটি পেশের মধ্য দিয়ে মুশরিকদের সাথে সকল সম্পর্ক ছিন্ন করে পরবর্তী বছর থেকে তাদের হজ নিষিদ্ধ করা হয়।

দ্বিতীয় ভাষণটি (৬ষ্ঠ রুকু থেকে ৯ম রুকুর শেষ পর্যন্ত) ৯ম হিজরির রজব মাসে বা তার কিছু আগে নাজিল হয়। সে সময়ে নবি সা. তবুক যুদ্ধের প্রস্তুতি গ্রহণ করছিলেন। ইসলাম বিজয়ী শক্তি হিসেবে মাথা উঁচু করে টিকে থাকবে না এখানেই শেষ হয়ে যাবে সেই প্রশ্নে জান-মাল দিয়ে আল্লাহর পথে যুদ্ধ করার জন্য ঈমানদারদের উদ্বুদ্ধ করা হয়েছে এবং যাদের মধ্যে ঈমানের দুর্বলতা বা আলস্য পেয়ে বসেছিল তাদেরকে তিরস্কার করা হয়েছে। 

তৃতীয় ভাষণটি ১০ম রুকু থেকে শেষ পর্যন্ত যা তবুক যুদ্ধ থেকে ফিরে আসার পর নাজিল হয়। এখানে মুনাফিকদের কার্যকলাপের বিরুদ্ধে হুশিয়ারী উচ্চারণ করা হয়েছে। আল্লাহর পথে জিহাদের ব্যাপারে যারা দুর্বলতা প্রদর্শন করবে তাদের ঈমান সংশয়পূর্ণ। জিহাদ ঈমান ও কুফরের মাপকাঠি। নিষ্ঠাবান কিছু মুসলমান দুর্বলতার কারণে যুদ্ধে শরীক না হওয়ার কারণে তাদের অপরাধ ক্ষমা করার কথা এখানে বলা হয়েছে।

আয়াত-৩৮

یٰۤاَیُّهَا الَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡا مَا لَكُمۡ اِذَا قِیۡلَ لَكُمُ انۡفِرُوۡا فِیۡ سَبِیۡلِ اللّٰهِ اثَّاقَلۡتُمۡ اِلَی الۡاَرۡضِ ؕ اَرَضِیۡتُمۡ بِالۡحَیٰوۃِ الدُّنۡیَا مِنَ الۡاٰخِرَۃِ ۚ فَمَا مَتَاعُ الۡحَیٰوۃِ الدُّنۡیَا فِی الۡاٰخِرَۃِ اِلَّا قَلِیۡلٌ

হে ঈমানদারগগণ! তোমাদের কি হল যে, যখন তোমাদেরকে আল্লাহর পথে অভিযানে বের হতে বলা হয়, তখন তোমরা ভারাক্রান্ত হয়ে যমীনে ঝুঁকে পড়? তোমরা কি আখেরাতের পরিবর্তে দুনিয়ার জীবনে পরিতুষ্ট হয়েছ? আখেরাতের তুলনায় দুনিয়ার জীবনের ভোগের উপকরণ তো নগণ্য।

আল্লাহপাক উদ্বুদ্ধ করার সাথে সাথে তিরস্কারও করেছেন। রসুলুল্লাহ সা.-এর পক্ষ থেকে অভিযানে বের হওয়ার নির্দেশ প্রদান করা হয়েছে; এমতাবস্থায় জমিন আঁকড়ে বসে থাকা, এটিই প্রমাণ করে যে আখেরাতের তুলনায় দুনিয়াকে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে। দুনিয়ার জীবনের সাজ-সরঞ্জাম ও ভোগ্যদ্রব্য আখেরাতের তুলনায় খুবই নগন্য। দুনিয়ার জীবন খুবই স্বল্পাস্থায়ী ও নানাবিধ রোগব্যাধি ও ঝামেলা-ঝক্কিতে পূর্ণ, পক্ষান্তরে আখেরাতের জীবন স্থায়ী এবং সেখানকার সরঞ্জাম ও ভোগ্যদ্রব্য অতি লোভনীয় যা কখনই কল্পনা করা যায় না।

এই সম্পর্কে সুরা নিসার ৭৫ নং আয়াতে আল্লাহ তায়ালা বলেন-

وَ مَا لَكُمۡ لَا تُقَاتِلُوۡنَ فِیۡ سَبِیۡلِ اللّٰهِ وَ الۡمُسۡتَضۡعَفِیۡنَ مِنَ الرِّجَالِ وَ النِّسَآءِ وَ الۡوِلۡدَانِ الَّذِیۡنَ یَقُوۡلُوۡنَ رَبَّنَاۤ اَخۡرِجۡنَا مِنۡ هٰذِهِ الۡقَرۡیَۃِ الظَّالِمِ اَهۡلُهَا ۚ وَ اجۡعَلۡ لَّنَا مِنۡ لَّدُنۡكَ وَلِیًّا ۚۙ وَّ اجۡعَلۡ لَّنَا مِنۡ لَّدُنۡكَ نَصِیۡرًا

আর তোমাদের কি হল যে, তোমরা যুদ্ধ করবে না আল্লাহর পথে এবং অসহায় নরনারী এবং শিশুদের জন্য, যারা বলে, হে আমাদের রব! এ জনপদ-যার অধিবাসী যালিম, তা-থেকে আমাদেরকে বের করুন; আর আমাদের জন্য আপনার পক্ষ থেকে কাউকে অভিভাবক করুন এবং আপনার পক্ষ থেকে কাউকে আমাদের সহায় করুন

এখানে আল্লাহ তায়ালা জিহাদের নির্দেশ দিয়ে বান্দাকে পরীক্ষা করে নিচ্ছেন যারা দুনিয়ার মোহ ত্যাগ করে জিহাদে ঝাঁপিয়ে পড়বে তারাই সফলকাম। সুরা আনকাবুতে ২নং আয়াতে আল্লাহ বলেন-

اَحَسِبَ النَّاسُ اَنۡ یُّتۡرَكُوۡۤا اَنۡ یَّقُوۡلُوۡۤا اٰمَنَّا وَ هُمۡ لَا یُفۡتَنُوۡنَ

মানুষ কি মনে করেছে যে, আমরা ঈমান এনেছি এ কথা বললেই তাদেরকে পরীক্ষা না করে অব্যাহতি দেয়া হবে

৩৮ নং আয়াতের শেষাংশের দুনিয়ার জীবনের ভোগ সামগ্রী আখেরাতে সামান্য প্রমাণিত হবে। এর দুটো অর্থ এরকম হতে পারে

১।  আখেরাতের অনন্ত জীবন এবং সীমা সংখ্যাহীন ভোগ সামগ্রী দেখার পর তোমরা জানতে পারবে, দুনিয়ার সুখাশ্চর্য এবং বিলাস সামগ্রী আখেরাতের সীমাহীন সম্ভাবনা এবং সেই অন্তহীন নিয়ামতে পরিপূর্ণ সুবিশাল রাজ্যের তুলনায় কিছুই নয় । তোমরা তখন আফসোস করতে থাকবে।

২।  দুনিয়ার জীবনের বিলাস সামগ্রী আখেরাতে কোন কাজে লাগবে না। এখানে যতই ঐশ্বর্য সম্পদ ও সাজ সরঞ্জাম তোমরা সংগ্রহ করো না শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করার সাথে সাথেই সবকিছু অকেজো হয়ে যাবে। এখানকার কোন জিনিসই তোমাদের সাথে স্থানান্তরিত হবে না। এখানকার সাজ-সরঞ্জাম, বিষয়াদি, সময়ের যে অংশটুকু তোমরা আল্লাহকে সন্তুষ্টি করার জন্য কুরবানী করেছো এবং যে জিনিসকে ভালবাসার ওপর তোমরা আল্লাহ ও তাঁর দ্বীনের প্রতি ভালবাসাকে প্রাধান্য দিয়েছে একমাত্র সেই অংশেই তোমরা সেখানে পাবে।

আয়াত-৩৯

اِلَّا تَنۡفِرُوۡا یُعَذِّبۡكُمۡ عَذَابًا اَلِیۡمًا ۬ۙ وَّ یَسۡتَبۡدِلۡ قَوۡمًا غَیۡرَكُمۡ وَ لَا تَضُرُّوۡهُ شَیۡئًا ؕ وَ اللّٰهُ عَلٰی كُلِّ شَیۡءٍ قَدِیۡرٌ

যদি তোমরা অভিযানে বের না হও, তবে তিনি তোমাদেরকে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি দেবেন এবং অন্য জাতিকে তোমাদের পরিবর্তে আনয়ন করবেন এবং তোমরা তার কোনই ক্ষতি করতে পারবে না। আর আল্লাহ্ সব কিছুর উপর ক্ষমতাবান।

যদি রসুলের সা. নির্দেশ মেনে বের না হওয়া যায় তার পরিণতি বলে দেওয়া হয়েছে যে, সব আমল বরবাদ করে দিয়ে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি প্রদান করা হবে। মুসলমানদের সরকার বা রাষ্ট্রপ্রধানের পক্ষে তার নাগরিকদের যুদ্ধের ডাক দেওয়া হলে তা ফরজে আইন হয়ে যায়। সেসময়ে অন্য কিছু ভাবার সুযোগ থাকে না। এটা আমাদের উপলব্ধি করতে হবে যে, আল্লাহর পক্ষ থেকে মুসলমানদের সশস্ত্র যুদ্ধের নির্দেশ মদিনায় একটি ইসলামী সরকার গঠনের পরই দেওয়া হয়েছে। কোনো ব্যক্তি, গোষ্ঠী বা দল যুদ্ধের ডাক দিতে পারে না। দেশের প্রচলিত আইনে নিয়মতান্ত্রিক পন্থায় আন্দোলন-সংগ্রাম করতে পারে। সমাবেশ, মিছিল, মিটিং করার অধিকার সাংবিধানিকভাবে স্বীকৃত এবং আক্রান্ত হলে আত্মরক্ষার অধিকারও রয়েছে।

এই আয়াত -যদি আল্লাহর পথে জিহাদে বের না হলে দুটো শাস্তির উল্লেখ করা হয়েছেঃ

১. বড় পীড়াদায়ক আযাব (পরকালে)

২. তোমাদের স্থলে অপর কোন জাতিকে, দলকে অথবা গোষ্ঠীকে প্রতিষ্ঠিত করা হবে।

পরকালের শান্তি – দুনিয়ার কোন শাস্তি বা কষ্টের সাথে তুলনা চলে না। আখেরাতের আগুনের তীব্রতা দুনিয়ার আগুনের চেয়ে অনেক অনেক গুণ তীব্র। (৭০ থেকে ৭০০ গুণ) দোযখের আগুনের রং কালো দুনিয়ায় আগুনের মত নয় । আখিরাতে কোন শাস্তির তীব্রতা দুনিয়ার শাস্তির সাথে তুলনা করা চলেনা।

সুরা মুহাম্মদের ৩৮ নং আয়াতে আল্লাহ তায়ালা বলেন

هٰۤاَنۡتُمۡ هٰۤؤُلَآءِ تُدۡعَوۡنَ لِتُنۡفِقُوۡا فِیۡ سَبِیۡلِ اللّٰهِ ۚ فَمِنۡكُمۡ مَّنۡ یَّبۡخَلُ ۚ وَ مَنۡ یَّبۡخَلۡ فَاِنَّمَا یَبۡخَلُ عَنۡ نَّفۡسِهٖ ؕ وَ اللّٰهُ الۡغَنِیُّ وَ اَنۡتُمُ الۡفُقَرَآءُ ۚ وَ اِنۡ تَتَوَلَّوۡا یَسۡتَبۡدِلۡ قَوۡمًا غَیۡرَكُمۡ ۙ ثُمَّ لَا یَكُوۡنُوۡۤا اَمۡثَالَكُمۡ

তোমরাই তো তারা যাদেরকে আল্লাহর পথে ব্যয় করতে বলা হচ্ছে অথচ তোমাদের অনেকে কৃপণতা করছে; যারা কার্পণ্য করে, তারা তো কার্পণ্য করে নিজেদের প্রতি। আল্লাহ অভাবমুক্ত এবং তোমরা অভাবগ্রস্ত। যদি তোমরা বিমুখ হও, তাহলে তিনি অন্য জাতিকে তোমাদের স্থলবর্তী করবেন; অতঃপর তারা তোমাদের মত হবে না।

আয়াত-৪০

اِلَّا تَنۡصُرُوۡهُ فَقَدۡ نَصَرَهُ اللّٰهُ اِذۡ اَخۡرَجَهُ الَّذِیۡنَ كَفَرُوۡا ثَانِیَ اثۡنَیۡنِ اِذۡ هُمَا فِی الۡغَارِ اِذۡ یَقُوۡلُ لِصَاحِبِهٖ لَا تَحۡزَنۡ اِنَّ اللّٰهَ مَعَنَا ۚ فَاَنۡزَلَ اللّٰهُ سَكِیۡنَتَهٗ عَلَیۡهِ وَ اَیَّدَهٗ بِجُنُوۡدٍ لَّمۡ تَرَوۡهَا وَ جَعَلَ كَلِمَۃَ الَّذِیۡنَ كَفَرُوا السُّفۡلٰی ؕ وَ كَلِمَۃُ اللّٰهِ هِیَ الۡعُلۡیَا ؕ وَ اللّٰهُ عَزِیۡزٌ حَكِیۡمٌ

যদি তোমরা তাকে সাহায্য না কর, তবে আল্লাহ তো তাকে সাহায্য করেছিলেন যখন কাফেররা তাকে বহিস্কার করেছিল এবং তিনি ছিলেন দুজনের দ্বিতীয়জন, যখন তারা উভয়ে গুহর মধ্যে ছিল; তিনি তখন তার সঙ্গীকে বলেছিলেন, বিষন্ন হয়ে না, আল্লাহ তো আমাদের সাথে আছেন। অতঃপর আল্লাহ তার উপর তার প্রশান্তি নাযিল করেন এবং তাকে শক্তিশালী করেন এমন এক সৈন্যবাহিনী দ্বারা যা তোমরা দেখনি এবং তিনি কাফেরদের কথা হেয় করেন। আর আল্লাহর কথাই সমুন্নত এবং আল্লাহ পরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময়।

দীন প্রতিষ্ঠার কাজটা একান্তভাবে আল্লাহর এবং যারা এই কাজ করে তারা মূলত আল্লাহর সাহায্যকারী। আল্লাহর পক্ষে নবি-রসুলগণ এই কাজটি করেছেন। মক্কায় দীর্ঘ তেরোটি বছর রসুলুল্লাহ সা. নানাভাবে নিপীড়ন -নির্যাতনের মুখোমুখি হয়েছেন এবং সেসময়ে আল্লাহই তাঁকে সাহায্য করেছেন। মক্কা থেকে মদিনায় হিজরত করার সময় উল্লেখ করে আল্লাহপাক বলেছেন সেই কঠিন সময়ে তিনিই তাঁর নবি সা.-কে সাহায্য করেছেন। সাওয়ার গুহায় আত্মগোপন করে থাকার সময় শত্রুরা যখন গুহার নিকটে চলে এসেছিল তখন আবু বকর রা. ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে পড়েন এবং সে সময়ে রসুলুল্লাহ সা. তাঁর সাথিকে সাহস যুগিয়েছেন, আমরা দু’জন মাত্র নই আল্লাহ আমাদের সাথে আছেন। আল্লাহ তায়ালা তাঁকে প্রশান্তি দান করেন এবং এমন বাহিনী দ্বারা শক্তি যুগিয়েছেন যা কেউ দেখেনি। আল্লাহপাক কাফেরদের কথাকে নিচু করে দিয়েছেন আর তিনি পরাক্রমশালী ও প্রজ্ঞাময়। তাঁর সাথে মোকাবেলায় কারো টিকে ওঠা সম্ভব নয়।

এই আয়াতে আমরা যে বিষয়গুলো উপলব্ধি করতে পারি।

আল্লাহর সাহায্য আসে সঠিক সময়েই: মানুষ যখন সবাই থেকে বঞ্চিত হয়, তখন আল্লাহর পক্ষ থেকেই আসে প্রকৃত সাহায্য।

আল্লাহর সান্নিধ্য সাহস জোগায়: রাসূলের এই কথায় সাহস পেয়েছিলেন আবু বকর (রাঃ)। আমরাও যে কোনো বিপদের সময় বলি:
“إِنَّ اللَّهَ مَعَنَا – “নিশ্চয়ই আল্লাহ আমাদের সাথে আছেন।”

আল্লাহর সাহায্য অদৃশ্য হলেও অপ্রতিরোধ্য: ফেরেশতা, দৃশ্যমান নয়—তবুও শক্তিশালী বাহিনী। দুনিয়ার বাহিনী হেরে যায়, আল্লাহর সৈন্যদের কাছে।

তাওয়াক্কুলের (আল্লাহর উপর ভরসা) প্রকৃত উদাহরণ: রাসূল দুশ্চিন্তায় না পড়ে আল্লাহর উপর ভরসা করেন। আমাদেরও প্রতিটি সিদ্ধান্তে ও বিপদে তাওয়াক্কুল করা উচিত।

আয়াত-৪১

اِنۡفِرُوۡا خِفَافًا وَّ ثِقَالًا وَّ جَاهِدُوۡا بِاَمۡوَالِكُمۡ وَ اَنۡفُسِكُمۡ فِیۡ سَبِیۡلِ اللّٰهِ ؕ ذٰلِكُمۡ خَیۡرٌ لَّكُمۡ اِنۡ كُنۡتُمۡ تَعۡلَمُوۡنَ

অভিযানে বের হয়ে পড়, হালকা অবস্থায় হোক বা ভারি অবস্থায় এবং জিহাদ কর আল্লাহর পথে তোমাদের সম্পদ ও জীবন দ্বারা। এটাই তোমাদের জন্য উত্তম, যদি তোমরা জানতে!

মুসলমানদের সাজ-সরঞ্জাম ও লোকবল যাই হোক যখন যুদ্ধের ডাক দেওয়া হয় তখন বেরিয়ে পড়া ফরজ হয়ে যায়। জানমাল দিয়ে আল্লাহর রাস্তায় জেহাদ করা সর্বোত্তম আমল; এটা ঈমানদার সবারই উপলব্ধি করা উচিৎ

তোমরা যুদ্ধে বের হও হালকা কিংবা ভারী অবস্থায়। শব্দ দুটি ব্যাপক অর্থে ব্যবহৃত হয় যেমন

১. হালকা ভারী ২. সশস্ত্র নিরস্ত্র ৩. অনুকুল প্রতিকুল ৪. স্বচ্ছলাবস্থায় অস্বচ্ছলাবস্থায় ৫. সুখে দুঃখে ৬. সন্তুষ্টি অসন্তুষ্টিতে ৭. সমৃদ্ধির মধ্যে হোক দারিদ্রের মধ্যে হোক ৮. বিপুল পরিমাণ সাজ সরঞ্জাম থাক বা একেবারে নিঃসম্বল অবস্থায় থাক। ৯. কাজ থেকে অবসরপ্রাপ্ত হোক, কাজের মধ্যে নিয়োজিত থাক। ১০. পেশাদার হোক বা ব্যবসায়ী হোক ১১. শক্তিশালী হোক কিংবা দুর্বল হোক ১২. যুবক হও আর বৃদ্ধ হও। অর্থাৎ সর্বাবস্থায় কোন ওযর না করেই দাঁড়িয়ে যেতে হবে এবং জিহাদের জন্য যাত্রা করতে হবে।

আয়াতের দ্বিতীয়াংশে বলা হচ্ছে তোমরা আল্লাহর পথে জিহাদ কর তোমাদের মালামাল, ধন সম্পদ দিয়ে ও তোমাদের জান প্রাণ দিয়ে এটাই তোমাদের জন্য উত্তম যদি তোমরা জানতে।

এ প্রসংগে সুরা তাওবার ১১১ নং আয়াতে বলা হয়েছে

 اِنَّ اللّٰهَ اشۡتَرٰی مِنَ الۡمُؤۡمِنِیۡنَ اَنۡفُسَهُمۡ وَ اَمۡوَالَهُمۡ بِاَنَّ لَهُمُ الۡجَنَّۃَ ؕ یُقَاتِلُوۡنَ فِیۡ سَبِیۡلِ اللّٰهِ فَیَقۡتُلُوۡنَ وَ یُقۡتَلُوۡنَ ۟ وَعۡدًا عَلَیۡهِ حَقًّا فِی التَّوۡرٰىۃِ وَ الۡاِنۡجِیۡلِ وَ الۡقُرۡاٰنِ ؕ وَ مَنۡ اَوۡفٰی بِعَهۡدِهٖ مِنَ اللّٰهِ فَاسۡتَبۡشِرُوۡا بِبَیۡعِكُمُ الَّذِیۡ بَایَعۡتُمۡ بِهٖ ؕ وَ ذٰلِكَ هُوَ الۡفَوۡزُ الۡعَظِیۡمُ

নিশ্চয় আল্লাহ মুমিনদের কাছ থেকে তাদের জীবন ও সম্পদ কিনে নিয়েছেন (এর বিনিময়ে) যে, তাদের জন্য আছে জান্নাত। তারা আল্লাহ্র পথে যুদ্ধ করে, অতঃপর তারা মারে ও মরে তাওরাত, ইঞ্জীল ও কুরআনে এ সম্পর্কে তাদের হক ওয়াদা রয়েছে। আর নিজ প্রতিজ্ঞা পালনে আল্লাহর চেয়ে শ্রেষ্ঠতর কে আছে? সুতরাং তোমরা যে সওদা করেছ সে সওদার জন্য আনন্দিত হও। আর সেটাই তো মহাসাফল্য।

এই প্রসঙ্গে সুরা সফ এর ১০-১৩ নং আয়াতে বলা হয়েছে

یٰۤاَیُّهَا الَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡا هَلۡ اَدُلُّكُمۡ عَلٰی تِجَارَۃٍ تُنۡجِیۡكُمۡ مِّنۡ عَذَابٍ اَلِیۡمٍ –  تُؤۡمِنُوۡنَ بِاللّٰهِ وَ رَسُوۡلِهٖ وَ تُجَاهِدُوۡنَ فِیۡ سَبِیۡلِ اللّٰهِ بِاَمۡوَالِكُمۡ وَ اَنۡفُسِكُمۡ ؕ ذٰلِكُمۡ خَیۡرٌ لَّكُمۡ اِنۡ كُنۡتُمۡ تَعۡلَمُوۡنَ  – یَغۡفِرۡ لَكُمۡ ذُنُوۡبَكُمۡ وَ یُدۡخِلۡكُمۡ جَنّٰتٍ تَجۡرِیۡ مِنۡ تَحۡتِهَا الۡاَنۡهٰرُ وَ مَسٰكِنَ طَیِّبَۃً فِیۡ جَنّٰتِ عَدۡنٍ ؕ ذٰلِكَ الۡفَوۡزُ الۡعَظِیۡمُ  – وَ اُخۡرٰی تُحِبُّوۡنَهَا ؕ نَصۡرٌ مِّنَ اللّٰهِ وَ فَتۡحٌ قَرِیۡبٌ ؕ وَ بَشِّرِ الۡمُؤۡمِنِیۡنَ


হে ঈমানদারগণ! আমি কি তোমাদেরকে এমন এক ব্যবসার সন্ধান দেব, যা তোমাদেরকে রক্ষা করবে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি থেকে। তা এই যে, তোমরা আল্লাহ ও তার রাসূলের উপর ঈমান আনবে এবং তোমরা তোমাদের ধন-সম্পদ ও জীবন দ্বারা আল্লাহর পথে জিহাদ করবে। এটাই তোমাদের জন্য শ্ৰেয় যদি তোমরা জানতে। আল্লাহ তোমাদের পাপসমূহ ক্ষমা করে দেবেন এবং তোমাদেরকে প্রবেশ করাবেন জান্নাতে যার পাদদেশে নদী প্রবাহিত, এবং স্থায়ী জান্নাতের উত্তম বাসগৃহে। এটাই মহাসাফল্য। এবং (তিনি দান করবেন) আরও একটি অনুগ্রহ, যা তোমরা পছন্দ কর। আল্লাহর পক্ষ থেকে সাহায্য ও আসন্ন বিজয়; আর আপনি মুমিনদেরকে সুসংবাদ দিন।

আয়াত-৪২

لَوۡ كَانَ عَرَضًا قَرِیۡبًا وَّ سَفَرًا قَاصِدًا لَّاتَّبَعُوۡكَ وَ لٰكِنۡۢ بَعُدَتۡ عَلَیۡهِمُ الشُّقَّۃُ ؕ وَ سَیَحۡلِفُوۡنَ بِاللّٰهِ لَوِ اسۡتَطَعۡنَا لَخَرَجۡنَا مَعَكُمۡ ۚ یُهۡلِكُوۡنَ اَنۡفُسَهُمۡ ۚ وَ اللّٰهُ یَعۡلَمُ اِنَّهُمۡ لَكٰذِبُوۡنَ

যদি সহজে সম্পদ লাভের আশা থাকত ও সফর সহজ হত তবে তারা অবশ্যই আপনার অনুসরণ করত, কিন্তু তাদের কাছে যাত্রাপথ সুদীর্ঘ মনে হল। আর অচিরেই তারা আল্লাহর নামে শপথ করে বলবে, পারলে আমরা নিশ্চয়ই তোমাদের সাথে বের হতাম। তারা তাদের নিজেদেরকেই ধ্বংস করে। আর আল্লাহ জানেন নিশ্চয় তারা মিথ্যাবাদী।

এই আয়াতে মুনাফিকদের প্রসঙ্গে বলা হয়েছে। তবুক যুদ্ধ ছিল তৎকালের সুপার পাওয়ার রোম সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে। ছিল প্রচণ্ড গরম এবং মদিনা থেকে অনেক দূর সিরিয়া সীমান্তে সর্বোপরি সময়টা ছিল ফসল উঠানোর মওসুম। মুনাফিকরা এই যুদ্ধে নিজেদের বিপদ উপলব্ধি করছিল। আল্লাহ সেটিই স্মরণ করে দিয়েছেন, যাত্রাপথ যদি সহজ হতো এবং গণিমতের মাল লাভের সম্ভাবনা থাকতো তাহলে অবশ্যই তারা নবিকে সা. অনুসরণ করতো। এখন তারা মিথ্যার আশ্রয় নিয়ে নানা ওজর পেশ করবে। ওজর পেশ করা আল্লাহ তায়ালার পছন্দ নয়।

তাবুকের যুদ্ধে মুনাফিকদের পাশাপাশি অংশগ্রহণ না করা তিনজন বিশিষ্ট সাহাবীর ইতিহাস ইসলামী ইতিহাসে অনন্য শিক্ষা বহন করে। তারা মুনাফিক ছিলেন না, বরং প্রকৃত ঈমানদার ছিলেন। তবে কিছুটা অলসতা ও গাফিলতির কারণে সময়মতো রওনা হননি। তারা হলেন: ১। কাঅব ইবনু মালিক (রাঃ) ২। হিলাল ইবনু উমাইয়া (রাঃ) ৩। মুরারাহ ইবনু রাবি আল-আমরি (রাঃ)

তাদের সম্পর্কে কাঅব ইবনু মালিক (রাঃ) এর বক্তব্য সম্পর্ন ঘটনা চলে আসে, যা সহীহ বুখারীর ৪৪১৮ নং হাদিসে উল্লেখ করা হয়েছে।

‘আবদুল্লাহ ইবনু কা‘ব ইবনু মালিক (রহ.) হতে বর্ণিত। কা‘ব (রাঃ) অন্ধ হয়ে গেলে তাঁর সন্তানের মধ্য থেকে যিনি তাঁর সাহায্যকারী ও পথপ্রদর্শনকারী ছিলেন, তিনি (‘আবদুল্লাহ্) বলেন, আমি কা‘ব ইবনু মালিক (রাঃ)-কে বলতে শুনেছি, যখন তাবূক যুদ্ধ থেকে তিনি পশ্চাতে থেকে যান তখনকার অবস্থা সম্পর্কে তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম যতগুলো যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন তার মধ্যে তাবূক যুদ্ধ ব্যতীত আমি আর কোন যুদ্ধ থেকে পেছনে থাকিনি। তবে আমি বদর যুদ্ধেও অংশগ্রহণ করিনি। কিন্তু উক্ত যুদ্ধ থেকে যাঁরা পেছনে পড়ে গেছেন, তাদের কাউকে ভৎর্সনা করা হয়নি। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম কেবল কুরাইশ দলের সন্ধানে বের হয়েছিলেন। অবশেষে আল্লাহ তা‘আলা তাঁদের এবং তাঁদের শত্রু বাহিনীর মধ্যে অঘোষিত যুদ্ধ সংঘটিত করেন। আর আকাবার রাতে যখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদের থেকে ইসলামের উপর অঙ্গীকার গ্রহণ করেন, আমি তখন তাঁর সঙ্গে ছিলাম। ফলে বদর প্রান্তরে উপস্থিত হওয়াকে আমি প্রিয়তর ও শ্রেষ্ঠতর বলে বিবেচনা করিনি। যদিও আকাবার ঘটনা অপেক্ষা লোকেদের মধ্যে বদরের ঘটনা বেশী মাশহুর ছিল। আর আমার অবস্থার বিবরণ এই-তাবূক যুদ্ধ থেকে আমি যখন পেছনে থাকি তখন আমি এত অধিক সুস্থ, শক্তিশালী ও সচ্ছল ছিলাম যে আল্লাহর কসম! আমার কাছে কখনো ইতোপূর্বে কোন যুদ্ধে একই সঙ্গে দু’টো যানবাহন জোগাড় করা সম্ভব হয়নি, যা আমি এ যুদ্ধের সময় জোগাড় করেছিলাম। আর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম যে অভিযান পরিচালনার সংকল্প গ্রহণ করতেন, বাহ্যত তার বিপরীত দেখাতেন। এ যুদ্ধ ছিল ভীষণ উত্তাপের সময়, অতি দূরের যাত্রা, বিশাল মরুভূমি এবং বহু শত্রুসেনার মোকাবালা করার। কাজেই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ অভিযানের অবস্থা এবং কোন এলাকায় যুদ্ধ পরিচালনা করতে যাবেন তাও মুসলিমদের কাছে প্রকাশ করে দেন যাতে তারা যুদ্ধের প্রয়োজনীয় সামান জোগাড় করতে পারে। এদিকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সাথে মুসলিমের সংখ্যা অনেক ছিল এবং তাদের সংখ্যা কোন নথিপত্রেও হিসেব করে রাখা হতো না।

কা‘ব (রাঃ) বলেন, যার ফলে যে কোন লোক যুদ্ধাভিযান থেকে বিরত থাকতে ইচ্ছা করলে তা সহজেই করতে পারত এবং ওয়াহী মারফত এ খবর না জানানো পর্যন্ত তা সংগোপন থাকবে বলে সে ধারণা করত। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ অভিযান পরিচালনা করেছিলেন এমন সময় যখন ফল-মূল পাকার ও গাছের ছায়ায় বিশ্রাম নেয়ার সময় ছিল। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম স্বয়ং এবং তাঁর সঙ্গী মুসলিম বাহিনী অভিযানে যাত্রার প্রস্তুতি গ্রহণ করে ফেলেন। আমিও প্রতি সকালে তাঁদের সঙ্গে রওয়ানা হওয়ার প্রস্তুতি গ্রহণ করতে থাকি। কিন্তু কোন সিদ্ধান্তে পৌঁছতে পারিনি। মনে মনে ধারণা করতে থাকি, আমি তো যখন ইচ্ছা পারব। এই দোটানায় আমার সময় কেটে যেতে লাগল। এদিকে অন্য লোকেরা পূর্ণ প্রস্তুতি নিয়ে ফেলল। ইতোমধ্যে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম এবং তাঁর সাথী মুসলিমগণ রওয়ানা করলেন অথচ আমি কোন সিদ্ধান্ত নিতে পারলাম না। আমি মনে মনে ভাবলাম, আচ্ছা ঠিক আছে, এক দু’দিনের মধ্যে আমি প্রস্তুত হয়ে পরে তাঁদের সঙ্গে গিয়ে মিলব। এভাবে আমি প্রতিদিন বাড়ি হতে প্রস্তুতি নেয়ার উদ্দেশে বের হই, কিন্তু কিছু না করেই ফিরে আসি। আবার বের হই, আবার কিছু না করে ঘরে ফিরে আসি। ইত্যবসরে বাহিনী অগ্রসর হয়ে অনেক দূর চলে গেল। আর আমি রওয়ানা করে তাদের সঙ্গে রাস্তায় মিলিত হওয়ার ইচ্ছা পোষণ করতে লাগলাম। আফসোস যদি আমি তাই করতাম! কিন্তু তা আমার ভাগ্যে জোটেনি। এরপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম রওয়ানা হওয়ার পর আমি লোকেদের মধ্যে বের হয়ে তাদের মাঝে বিচরণ করতাম। এ কথা আমার মনকে পীড়া দিত যে, আমি তখন (মদিনা্য়) মুনাফিক এবং দুর্বল ও অক্ষম লোক ব্যতীত অন্য কাউকে দেখতে পেতাম না। এদিকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাবূক পৌঁছার আগে পর্যন্ত আমার ব্যাপারে আলোচনা করেননি। অনন্তর তাবূকে এ কথা তিনি লোকেদের মাঝে বসে জিজ্ঞেস করে বসলেন, কা‘ব কী করল?

বানু সালামাহ গোত্রের এক লোক বলল, হে আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম! তার ধন-সম্পদ ও অহঙ্কার তাকে আসতে দেয়নি। এ কথা শুনে মু‘আয ইবনু জাবাল (রাঃ) বললেন, তুমি যা বললে তা ঠিক নয়। হে আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম! আল্লাহর কসম, আমরা তাঁকে উত্তম ব্যক্তি বলে জানি। তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম নীরব রইলেন। কা‘ব ইবনু মালিক (রাঃ) বলেন, আমি যখন জানতে পারলাম যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম মদিনা মুনাওয়ারায় ফিরে আসছেন, তখন আমি চিন্তিত হয়ে গেলাম এবং মিথ্যা ওজুহাত খুঁজতে থাকলাম। মনে স্থির করলাম, আগামীকাল এমন কথা বলব যাতে করে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর ক্রোধকে ঠান্ডা করতে পারি। আর এ সম্পর্কে আমার পরিবারস্থ জ্ঞানীগুণীদের থেকে পরামর্শ গ্রহণ করতে থাকি। এরপর যখন প্রচারিত হল যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম মদিনা্য় এসে পৌঁছে যাচ্ছেন, তখন আমার অন্তর থেকে মিথ্যা দূর হয়ে গেল। আর মনে দৃঢ় প্রত্যয় হল যে, এমন কোন উপায়ে আমি তাঁকে কখনো ক্রোধমুক্ত করতে সক্ষম হব না, যাতে মিথ্যার লেশ থাকে। অতএব আমি মনে মনে স্থির করলাম যে, আমি সত্য কথাই বলব। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম সকাল বেলায় মদিনা্য় প্রবেশ করলেন। তিনি সফর থেকে প্রত্যাবর্তন করে প্রথমে মসজিদে গিয়ে দু’রাক‘আত সালাত আদায় করতেন, তারপর লোকদের সামনে  বসতেন। যখন নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরূপ করলেন, তখন যারা পশ্চাদপদ ছিলেন তাঁরা তাঁর কাছে এসে শপথ করে করে অপারগতা ও আপত্তি পেশ করতে লাগল। এরা সংখ্যায় আশির অধিক ছিল। অতঃপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বাহ্যত তাদের ওযর-আপত্তি গ্রহণ করলেন, তাদের বাই‘আত করলেন এবং তাদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করলেন। কিন্তু তাদের অন্তরের অবস্থা আল্লাহর হাওয়ালা করে দিলেন। [কা‘ব (রাঃ) বলেন] আমিও এরপর নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সামনে হাজির হলাম। আমি যখন তাঁকে সালাম দিলাম তখন তিনি রাগান্বিত চেহারায় মুচকি হাসি হাসলেন। তারপর বললেন, এসো। আমি সে মতে এগিয়ে গিয়ে একেবারে তাঁর সম্মুখে বসে গেলাম। তখন তিনি আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, কী কারণে তুমি অংশগ্রহণ করলে না? তুমি কি যানবাহন ক্রয় করনি? তখন আমি বললাম, হ্যাঁ, করেছি। আল্লাহর কসম! এ কথা সুনিশ্চিত যে, আমি যদি আপনি ব্যতীত দুনিয়ার অন্য কোন ব্যক্তির সামনে বসতাম তাহলে আমি তার অসন্তুষ্টিকে ওযর-আপত্তি পেশের মাধ্যমে ঠান্ডা করার চেষ্টা করতাম। আর আমি তর্কে পটু। কিন্তু আল্লাহর কসম আমি পরিজ্ঞাত যে, আজ যদি আমি আপনার কাছে মিথ্যা কথা বলে আমার প্রতি আপনাকে সন্তুষ্ট করার চেষ্টা করি তাহলে শীঘ্রই আল্লাহ তা‘আলা আপনাকে আমার প্রতি অসন্তুষ্ট করে দিতে পারেন। আর যদি আপনার কাছে সত্য প্রকাশ করি যাতে আপনি আমার প্রতি অসন্তুষ্ট হন, তবুও আমি এতে আল্লাহর ক্ষমা পাওয়ার অবশ্যই আশা করি। না, আল্লাহর কসম, আমার কোন ওযর ছিল না। আল্লাহর কসম! সেই যুদ্ধে আপনার সঙ্গে না যাওয়ার সময় আমি সর্বাপেক্ষা শক্তিশালী ও সামর্থ্যবান ছিলাম। তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, সে সত্য কথাই বলেছে। তুমি এখন চলে যাও, যতদিনে না তোমার সম্পর্কে আল্লাহ তা‘আলা ফায়সালা করে দেন। তাই আমি উঠে চলে গেলাম। তখন বানী সালিমার কতিপয় লোক আমার অনুসরণ করল। তারা আমাকে বলল, আল্লাহর কসম! তুমি ইতোপূর্বে কোন পাপ করেছ বলে আমাদের জানা নেই; তুমি (তাবূক যুদ্ধে) অংশগ্রহণ হতে বিরত অন্যান্যদের মতো রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কাছে একটি ওযর পেশ করে দিতে পারতে না? আর তোমার এ অপরাধের কারণে তোমার জন্য রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর ক্ষমা প্রার্থনাই তো যথেষ্ট ছিল। আল্লাহর কসম! তারা আমাকে বারবার কঠিনভাবে ভৎর্সনা করতে থাকে। ফলে আমি পূর্ব স্বীকারোক্তি থেকে ফিরে গিয়ে মিথ্যা বলার বিষয়ে মনে মনে চিন্তা করতে থাকি। এরপর আমি তাদের বললাম, আমার মতো এ কাজ আর কেউ করেছে কি? তারা জওয়াব দিল, হ্যাঁ, আরও দু’জন তোমার মতো বলেছে এবং তাদের ব্যাপারেও তোমার মতো একই ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। আমি তাদের জিজ্ঞেস করলাম, তারা কে কে? তারা বলল, একজন মুরারা ইবনু রবী আমরী এবং অপরজন হলেন, হিলাল ইবনু ‘উমাইয়াহ ওয়াকিফী। এরপর তারা আমাকে জানালো যে, তারা উভয়ে উত্তম মানুষ এবং তারা বদর যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছেন। সেজন্য দু’জনেই আদর্শস্থানীয়। যখন তারা তাদের নাম উল্লেখ করল, তখন আমি পূর্ব মতের উপর অটল রইলাম এবং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদের মধ্যকার যে তিনজন তাবূকে অংশগ্রহণ হতে বিরত ছিল তাদের সঙ্গে কথা বলতে মুসলিমদের নিষেধ করে দিলেন। তদনুসারে মুসলিমরা আমাদের এড়িয়ে চলল। আমাদের প্রতি তাদের আচরণ বদলে ফেলল। এমনকি এ দেশ যেন আমাদের কাছে অপরিচিত হয়ে গেল।

এ অবস্থায় আমরা পঞ্চাশ রাত অতিবাহিত করলাম। আমার অপর দু’জন সাথী তো সংকটে ও শোচনীয় অবস্থায় নিপতিত হলেন। তারা নিজেদের ঘরে বসে বসে কাঁদতে থাকেন। আর আমি যেহেতু অধিকতর যুবক ও শক্তিশালী ছিলাম তাই বাইরে বের হতাম, মুসলিমদের জামা‘আতে সালাত আদায় করতাম, বাজারে চলাফেরা করতাম কিন্তু কেউ আমার সঙ্গে কথা বলত না। আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর খিদমতে হাযির হয়ে তাঁকে সালাম দিতাম। যখন তিনি সালাত শেষে মজলিসে বসতেন তখন আমি মনে মনে বলতাম ও লক্ষ্য করতাম, তিনি আমার সালামের জবাবে তার ঠোঁটদ্বয় নেড়েছেন কি না। তারপর আমি তাঁর কাছাকাছি জায়গায় সালাত আদায় করতাম এবং গোপন দৃষ্টিতে তাঁর দিকে দেখতাম যে, আমি যখন সালাতে মগ্ন হতাম তখন তিনি আমার প্রতি দৃষ্টি দিতেন, আর যখন আমি তাঁর দিকে তাকাতাম তখন তিনি দৃষ্টি ফিরিয়ে নিতেন। এভাবে আমার প্রতি মানুষদের কঠোরতা ও এড়িয়ে চলা দীর্ঘকাল ধরে চলতে থাকে। একদা আমি আমার চাচাত ভাই ও প্রিয় বন্ধু আবূ ক্বাতাদাহ (রাঃ)-এর বাগানের প্রাচীর টপকে ঢুকে পড়ে তাঁকে সালাম দেই। কিন্তু আল্লাহর কসম তিনি আমার সালামের জওয়াব দিলেন না। আমি তখন বললাম, হে আবূ ক্বাতাদাহ! আপনাকে আমি আল্লাহর কসম দিয়ে জিজ্ঞেস করছি, আপনি কি জানেন যে, আমি আল্লাহ ও তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে ভালবাসি? তখন তিনি নীরবতা পালন করলেন। আমি পুনরায় তাঁকে কসম দিয়ে জিজ্ঞেস করলাম। তিনি এবারও কোন জবাব দিলেন না। আমি আবারো তাঁকে কসম দিয়ে জিজ্ঞেস করলাম। তখন তিনি বললেন, আল্লাহ ও তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম-ই ভাল জানেন। তখন আমার চক্ষুদ্বয় থেকে অশ্রু ঝরতে লাগল। আমি আবার প্রাচীর টপকে ফিরে এলাম। কা‘ব (রাঃ) বলেন, একদা আমি মদিনার বাজারে হাঁটছিলাম। তখন সিরিয়ার এক বণিক যে মদিনার বাজারে খাদ্যদ্রব্য বিক্রি করার উদ্দেশে এসেছিল, সে বলছে, আমাকে কা‘ব ইবনু মালিককে কেউ পরিচয় করে দিতে পারে কি? তখন লোকেরা তাকে আমার প্রতি ইশারা করে দেখিয়ে দিল। তখন সে এসে গাস্সানি বাদশার একটি পত্র আমার কাছে হস্তান্তর করল। তাতে লেখা ছিল, পর সমাচার এই, আমি জানতে পারলাম যে, আপনার সাথী আপনার প্রতি জুলুম করেছে। আর আল্লাহ আপনাকে মর্যাদাহীন ও নিরাশ্রয় সৃষ্টি করেননি। আপনি আমাদের দেশে চলে আসুন, আমরা আপনার সাহায্য-সহানুভূতি করব।

আমি যখন এ পত্র পড়লাম তখন আমি বললাম, এটাও আর একটি পরীক্ষা। তখন আমি চুলা খুঁজে তার মধ্যে পত্রটি নিক্ষেপ করে জ্বালিয়ে দিলাম। এ সময় পঞ্চাশ দিনের চল্লিশ দিন অতিবাহিত হয়ে গেছে। এমতাবস্থায় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর পক্ষ থেকে এক সংবাদবাহক আমার কাছে এসে বলল, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম নির্দেশ দিয়েছেন যে, আপনি আপনার স্ত্রী হতে পৃথক থাকবেন। আমি জিজ্ঞেস করলাম, আমি কি তাকে তালাক দিয়ে দিব, না অন্য কিছু করব? তিনি উত্তর দিলেন, তালাক দিতে হবে না বরং তার থেকে পৃথক থাকুন এবং তার নিকটবর্তী হবেন না। আমার অপর দু’জন সঙ্গীর প্রতি একই আদেশ পৌঁছালেন। তখন আমি আমার স্ত্রীকে বললাম, তুমি তোমার পিত্রালয়ে চলে যাও। আমার সম্পর্কে আল্লাহর ফায়সালা না হওয়া পর্যন্ত তুমি সেখানে থাক। কা‘ব (রাঃ) বলেন, আমার সঙ্গী হিলাল ইবনু উমাইয়্যার স্ত্রী রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর খিদমতে উপস্থিত হয়ে আরয করল, হে আল্লাহর রাসূল! হিলাল ইবনু উমাইয়্যা অতি বৃদ্ধ, এমন বৃদ্ধ যে, তাঁর কোন খাদিম নেই। আমি তাঁর খেদমত করি, এটা কি আপনি অপছন্দ করেন? নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, না, তবে সে তোমার বিছানায় আসতে পারবে না। সে বলল, আল্লাহর কসম! এ সম্পর্কে তার কোন অনুভূতিই নেই। আল্লাহর কসম! তিনি এ নির্দেশ পাওয়ার পর থেকে সর্বদা কান্নাকাটি করছেন। [কা‘ব (রাঃ) বলেন] আমার পরিবারের কেউ আমাকে পরামর্শ দিল যে, আপনিও যদি আপনার স্ত্রীর ব্যাপারে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কাছে অনুমতি চাইতেন যেমন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম হিলাল ইবনু উমায়্যার স্ত্রীকে তার (স্বামীর) খিদমাত করার অনুমতি দিয়েছেন। আমি বললাম, আল্লাহর কসম! আমি কখনো তার ব্যাপারে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কাছে অনুমতি চাইব না। আমি যদি তার ব্যাপারে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর অনুমতি চাই তবে তিনি কী বলেন, তা আমার জানা নেই। আমি তো নিজেই আমার খিদমতে সক্ষম। এরপর আরও দশরাত কাটালাম। এভাবে নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন থেকে আমাদের সঙ্গে কথা বলতে নিষেধ করেন তখন থেকে পঞ্চাশ রাত পূর্ণ হল। এরপর আমি পঞ্চাশতম রাত শেষে ফজরের সালাত আদায় করলাম এবং আমাদের এক ঘরের ছাদে এমন অবস্থায় বসে ছিলাম যে অবস্থার ব্যাপারে আল্লাহ তা‘আলা (কুরআনে) বর্ণনা করেছেন। আমার জান-প্রাণ দুর্বিষহ এবং গোটা জগৎটা যেন আমার জন্য প্রশস্ত হওয়া সত্ত্বে সংকীর্ণ হয়ে গিয়েছিল। এমন সময় শুনতে পেলাম এক চীৎকারকারীর চীৎকার। সে সালা পর্বতের উপর চড়ে উচ্চস্বরে ঘোষণা করছে, হে কা‘ব ইবনু মালিক! সুসংবাদ গ্রহণ করুন।

কা‘ব (রাঃ) বলেন, এ শব্দ আমার কানে পৌঁছামাত্র আমি সিজদা্য় পড়ে গেলাম। আর আমি বুঝলাম যে, আমার সুদিন ও খুশীর খবর এসেছে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম ফজরের সালাত আদায়ের পর আল্লাহ তা‘আলার পক্ষ হতে আমাদের তওবা কবূল হওয়ার সুসংবাদ প্রকাশ করেন। তখন লোকেরা আমার এবং আমার সঙ্গীদ্বয়ের কাছে সুসংবাদ দিতে থাকে এবং তড়িঘড়ি একজন অশ্বারোহী আমার কাছে আসে এবং আসলাম গোত্রের অপর এক ব্যক্তি দ্রুত আগমন করে পর্বতের উপর আরোহণ করতঃ চীৎকার দিতে থাকে। তার চীৎকারের শব্দ ঘোড়া অপেক্ষাও দ্রুত পৌঁছল। যার শব্দ আমি শুনেছিলাম সে যখন আমার কাছে সুসংবাদ প্রদান করতে আসল, তখন আমাকে সুসংবাদ প্রদান করার শুকরিয়া স্বরূপ আমার নিজের পরনের কাপড় দু’টো খুলে তাকে পরিয়ে দিলাম। আল্লাহর শপথ সে সময় ঐ দু’টো কাপড় ব্যতীত আমার কাছে আর কোন কাপড় ছিল না। ফলে আমি দু’টো কাপড় ধার করে পরিধান করলাম এবং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কাছে রওয়ানা হলাম। লোকেরা দলে দলে আমাকে ধন্যবাদ জানাতে আসলে লাগল। তারা তওবা কবূলের মুবারকবাদ জানাচ্ছিল। তারা বলছিল, তোমাকে মুবারাকবাদ যে আল্লাহ তা‘আলা তোমার তওবা কবূল করেছেন। কা‘ব (রাঃ) বলেন, অবশেষে আমি মসজিদে প্রবেশ করলাম। তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম সেখানে বসা ছিলেন এবং তাঁর চতষ্পার্শ্বে জনতার সমাবেশ ছিল। ত্বলহা ইবনু ‘উবাইদুল্লাহ (রাঃ) দ্রুত উঠে এসে আমার সঙ্গে মুসাফাহা করলেন ও মুবারকবাদ জানালেন। আল্লাহর কসম! তিনি ব্যতীত আর কোন মুহাজির আমার জন্য দাঁড়াননি। আমি ত্বলহার ব্যবহার ভুলতে পারব না। কা‘ব (রাঃ) বলেন, এরপর আমি যখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে সালাম জানালাম, তখন তাঁর চেহারা আনন্দের আতিশয্যে ঝকঝক করছিল। তিনি আমাকে বললেন, তোমার মাতা তোমাকে জন্মদানের দিন হতে যতদিন তোমার উপর অতিবাহিত হয়েছে তার মধ্যে উৎকৃষ্ট ও উত্তম দিনের সুসংবাদ গ্রহণ কর। কা‘ব বলেন, আমি আরয করলাম, হে আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম! এটা কি আপনার পক্ষ থেকে না আল্লাহর পক্ষ থেকে? তিনি বললেন, আমার পক্ষ থেকে নয় বরং আল্লাহর পক্ষ থেকে। আর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন খুশী হতেন তখন তাঁর চেহারা এত উজ্জ্বল ও ঝলমলে হত যেন পূর্ণিমার চাঁদের ফালি। এতে আমরা তাঁর সন্তুষ্টি বুঝতে পারতাম। আমি যখন তাঁর সম্মুখে বসলাম তখন আমি নিবেদন করলাম, হে আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম! আমার তওবা কবূলের শুকরিয়া স্বরূপ আমার ধন-সম্পদ আল্লাহ ও তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর পথে দান করতে চাই। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, তোমার কিছু মাল তোমার কাছে রেখে দাও। তা তোমার জন্য উত্তম। আমি বললাম, খাইবারে অবস্থিত আমার অংশটি আমার জন্য রাখলাম। আমি আরয করলাম, হে আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম! আল্লাহ তা‘আলা সত্য বলার কারণে আমাকে রক্ষা করেছেন, তাই আমার তওবা কবূলের নিদর্শন ঠিক রাখতে আমার বাকী জীবনে সত্যই বলব। আল্লাহর কসম! যখন থেকে আমি এ সত্য বলার কথা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কাছে জানিয়েছি, তখন থেকে আজ পর্যন্ত আমার জানা মতে কোন মুসলিমকে সত্য কথার বিনিময়ে এরূপ নিয়ামত আল্লাহ দান করেননি যে নিয়ামত আমাকে দান করেছেন। [কা‘ব (রাঃ) বলেন] যেদিন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সম্মুখে সত্য কথা বলেছি সেদিন হতে আজ পর্যন্ত অন্তরে মিথ্যা বলার ইচ্ছাও করিনি। আমি আশা পোষণ করি যে, বাকী জীবনও আল্লাহ তা‘আলা আমাকে মিথ্যা থেকে রক্ষা করবেন। আল্লাহর শপথ! ইসলাম গ্রহণের পর থেকে কখনো আমার উপর এত উৎকৃষ্ট নিয়ামত আল্লাহ প্রদান করেননি যা আমার কাছে শ্রেষ্ঠতর, তা হল রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কাছে আমার সত্য বলা ও তাঁর সঙ্গে মিথ্যা না বলা, যদি মিথ্যা বলতাম তবে মিথ্যাচারীদের মতো আমিও ধ্বংস হয়ে যেতাম।

কা‘ব (রাঃ) বলেন, আমাদের তিনজনের তওবা কবূল করতে বিলম্ব করা হয়েছে-যাদের তওবা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম কবূল করেছেন যখন তাঁরা তার কাছে শপথ করেছে, তিনি তাদের বাই‘আত গ্রহণ করেছেন এবং তাদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করেছেন। আমাদের বিষয়টি আল্লাহর ফায়সালা না হওয়া পর্যন্ত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম স্থগিত রেখেছেন।

এই সম্পর্কে সুরা তওবার ১১৮ নং আয়াতে বলা হয়েছে

وَّ عَلَی الثَّلٰثَۃِ الَّذِیۡنَ خُلِّفُوۡا ؕ حَتّٰۤی اِذَا ضَاقَتۡ عَلَیۡهِمُ الۡاَرۡضُ بِمَا رَحُبَتۡ وَ ضَاقَتۡ عَلَیۡهِمۡ اَنۡفُسُهُمۡ وَ ظَنُّوۡۤا اَنۡ لَّا مَلۡجَاَ مِنَ اللّٰهِ اِلَّاۤ اِلَیۡهِ ؕ ثُمَّ تَابَ عَلَیۡهِمۡ لِیَتُوۡبُوۡا ؕ اِنَّ اللّٰهَ هُوَ التَّوَّابُ الرَّحِیۡمُ

আর তিনি তাওবা কবুল করলেন অন্য তিনজনেরও(১), যাদের সম্পর্কে সিদ্ধান্ত স্থগিত রাখা হয়েছিল, যে পর্যন্ত না যমীন বিস্তৃত হওয়া সত্ত্বেও তাদের জন্য সেটা সংকুচিত হয়েছিল এবং তাদের জীবন তাদের জন্য দুর্বিষহ হয়েছিল আর তারা নিশ্চিত উপলব্ধি করেছিল যে, আল্লাহর পাকড়াও থেকে বাঁচার জন্য তিনি ছাড়া আর কোন আশ্রয়স্থল নেই। তারপর তিনি তাদের তাওবাহ কবুল করলেন যাতে তারা তাওবায় স্থির থাকে। নিশ্চয় আল্লাহ অধিক তাওবা কবুলকারী, পরম দয়ালু

শিক্ষাঃ

১. দুনিয়ার জীবনকে পরকালের উপর প্রাধান্য দেয়া যাবে না।

২. জিহাদ না করলে কঠিন শাস্তি পেতে হবে (ক) পরকালে কঠিন আযাব (খ) অন্য জাতি কর্তৃক লাঞ্ছনা

৩. আমরা জিহাদ না করলে আল্লাহ তায়ালার কোন ক্ষতি নেই।

৪. সর্বাবস্থায় আল্লাহর উপর ভরসা রাখতে হবে।

৫. যে কোন অবস্থায় যে কোন পরিস্থিতিতে আল্লাহর পথে বের হওয়ার ডাক আসলে বের হয়ে যাওয়া ফরয।

সুরা মুযযাম্মিল এর ১-১৩ নং আয়াতের তাফসির

সুরা নুর আয়াত ২৭-৩১ এর দারস

About Md Nazmul Azam

I am website developer.

Check Also

আল্লাহর পথে দাওয়াত বিষয়ে আলোচনা

পিডিএফ ডাউনলোড করুন দাওয়াত সূরা নাহল :  আয়াত ১২৫ ادْعُ إِلَى سَبِيلِ رَبِّكَ بِالْحِكْمَةِ وَالْمَوْعِظَةِ …

দলিলভিত্তিক ইবাদত ও জীবনপথ বইয়ের লেখকের বানী

দলিলভিত্তিক ইবাদত ও জীবনপথ (পাঠ-০১) নাজমুল আযম শামীম আমি নাজমুল আযম শামীম, প্রতিষ্ঠাতা- ইসলামিক দাওয়া …

সাওম বা রোজা সম্পর্কে আলোচনা

সাওম বা রোজা সিয়াম অর্থ: সিয়ামের আভিধানিক অর্থ হলো: বিরত থাকা। আর শরিয়তের পরিভাষায় অর্থ …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *