পিডিএফ ডাউনলোড করুন
দাওয়াত
সূরা নাহল : আয়াত ১২৫
ادْعُ إِلَى سَبِيلِ رَبِّكَ بِالْحِكْمَةِ وَالْمَوْعِظَةِ الْحَسَنَةِ وَجَادِلْهُمْ بِالَّتِي هِيَ أَحْسَنُ إِنَّ رَبَّكَ هُوَ أَعْلَمُ بِمَنْ ضَلَّ عَنْ سَبِيلِهِ وَهُوَ أَعْلَمُ بِالْمُهْتَدِينَ (১২৫)
অনুবাদঃ তোমরা রবের পথে হিকমত ও সুন্দর উপদেশের মাধ্যমে আহ্বান কর এবং সুন্দরতম পন্থায় তাদের সাথে বিতর্ক কর। নিশ্চয়ই একমাত্র তোমার রবই জানেন কে তার পথ থেকে ভ্রষ্ট হয়েছে এবং হিদায়াতপ্রাপ্তদের তিনি খুব ভালো করেই জানেন।
ব্যাখ্যাঃ এ আয়াতের মধ্যে আল্লাহ তায়ালা সর্বপ্রথম ঈমানের দাবিদার প্রত্যেক মুসলমানের উপরে ইসলামের দিকে মানুষকে ডাকার গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরেছেন। এবং এর পরই ইসলামের দিকে আহ্বানকারীকে বলে দেওয়া হয়েছে সে কিভাবে, কোন পদ্ধতি ও কৌশল অবলম্বনে দাওয়াতি কাজ করবে। উপরোক্ত আয়াতের আলোকে দাওয়াতি কাজের গুরুত্ব-প্রয়োজনীয়তা ও দাওয়াতি কাজের কর্মপন্থা ও কৌশল সম্পর্কে আলোচনা করা হলো :
ইসলামের দিকে মানুষকে ডাকার গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তাঃ
ইসলামের দিকে আহ্বানের গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা এতই বেশি যে, এ কাজ থেকে যদি কোনো ইসলামী সমাজ ও রাষ্ট্র বিরত থাকে তাহলে তারা আল্লাহর একটি ফরজ হুকুম অমান্য করার অপরাধে অপরাধী হবে। এ কাজকে আল্লাহ মুসলিম উম্মাহর উপরে ফরজ করে দিয়েছেন। এ সম্পর্কে আল্লাহ বলেছেন, সূরা আলে ইমরান : ১০৪
وَلْتَكُنْ مِنْكُمْ أُمَّةٌ يَدْعُونَ إِلَى الْخَيْرِ وَيَأْمُرُونَ بِالْمَعْرُوفِ وَيَنْهَوْنَ عَنِ الْمُنْكَرِ وَأُولَئِكَ هُمُ الْمُفْلِحُونَ “
তোমাদের মধ্যে একটা দল থাকা উচিত, যারা আহ্বান জানাবে সৎকর্মের প্রতি, নির্দেশ দেবে ভালো কাজের এবং বারণ করবে অন্যায় কাজ থেকে। আর তারাই হলো সফলকাম।”
যারা আল্লাহর পথে মানুষদেরকে আহ্বান করে তারা সমাজের শ্রেষ্ঠ মানুষ, তাদের মর্যাদা সবার উপরে। এ সম্পর্কে আল্লাহ তায়ালা বলেন, সূরা আলে ইমরান : ১১০
كُنْتُمْ خَيْرَ أُمَّةٍ أُخْرِجَتْ لِلنَّاسِ تَأْمُرُونَ بِالْمَعْرُوفِ وَتَنْهَوْنَ عَنِ الْمُنْكَرِ وَتُؤْمِنُونَ بِاللَّهِ
“তোমরা হলে সর্বোত্তম উম্মত, যাদেরকে মানুষের জন্য বের করা হয়েছে। তোমরা ভালো কাজের আদেশ দেবে এবং মন্দ কাজ থেকে বারণ করবে, আর আল্লাহর প্রতি ঈমান আনবে।”
উপরোক্ত বক্তব্য থেকে এটা স্পষ্ট হয়ে যায়, ইসলামের দিকে আহবান করা বা ডাকার গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম নিম্মে তার একটি চিত্র তুলে ধরা হলো :
দাওয়াতি কাজ করা আল্লাহর নির্দেশ ইসলামী দাওয়াহ প্রচার, প্রসার ও সম্প্রসারণে প্রতিটি মুসলমান নর-নারী আল্লাহর নিকট দায়বদ্ধ, এটা প্রত্যেক মুসলিম নর ও নারীর ওপর আল্লাহ তায়ালা ফরজ করে দিয়েছেন। আল্লাহ তায়ালা রাসূল সা.কে শেষ নবী হিসেবে রিসালাতের মহান দায়িত্ব অর্পণ করে প্রেরণ করেন এবং সকল মানুষের নিকট এ দাওয়াত পৌঁছে দেয়ার নির্দেশ দান করেন। যারা রাসূল সা.-এর আহ্বানে সাড়া দিয়ে ঈমান আনবে তাদের বেহেশতের সুসংবাদ এবং যারা এর বিরোধিতা করবে তাদের জন্য দোজখের আজাবের কথা ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। শেষ নবীর উম্মতদের ওপরও দাওয়াতি কাজ আল্লাহ ফরজ করেছেন যেটা উপরোক্ত আয়াত থেকে স্পষ্টভাবে জানা যায়।
এ ছাড়া অন্য আয়াতে আল্লাহ বলেন, সূরা কাসাস : ৮৭
وَادْعُ إِلَى رَبِّكَ وَلَا تَكُونَنَّ مِنَ الْمُشْرِكِينَ “
তোমরা তোমাদের রবের দিকে মানুষকে আহ্বান করো এবং তোমরা মুশরিকদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যেও না।”
আল্লাহ বিশেষ করে জ্ঞানীদের জন্য এ কাজ ফরয করেছেন, তারা যেন মানুষেদেরকে দ্বীনের শিক্ষা দেয় এবং শিরক ও গুমরাহি থেকে মানুষকে রক্ষা করে। যে ব্যক্তি ইসলাম সম্পর্কে যতটুকু জ্ঞান রাখে তার জন্য ততটুকু অন্যকে শিক্ষাদান করা ফরজ।
আল্লাহর পথে দাওয়াত নবী ও রাসূলদের কাজ সকল বিপর্যয় থেকে মানবজাতিকে রক্ষা করার লক্ষ্যে যুগে যুগে অসংখ্য নবী-রাসূল (আ) মানবসমাজে এসেছিলেন। আদি পিতা হযরত আদম (আ) থেকে শুরু করে হযরত নূহ, ইবরাহিম, ইসমাইল, ইসহাক, ইয়াকুব, লুত, সালেহ, হারুন, হুদ, ইউনূস, ইউসুফ, মূসা, দাউদ, সুলায়মান, লোকমান, ঈসা (আ) এবং সর্বশেষ রাসূল হযরত মুহাম্মদ সা. পর্যন্ত সকলেই ইসলামী দাওয়াতের মহান দায়িত্ব পালন করেছেন। পবিত্র কুরআনুল কারিমে ঘোষণা করা হয়েছে, সূরা আরাফ : ৫৯
لَقَدْ أَرْسَلْنَا نُوحًا إِلَى قَوْمِهِ فَقَالَ يَا قَوْمِ اعْبُدُوا اللَّهَ مَا لَكُمْ مِنْ إِلَهٍ غَيْرُهُ
“আমি নূহকে তাঁর জাতির কাছে প্রেরণ করেছিলাম তিনি তাদের কাছে বললেন, হে আমার জাতি তোমরা এক আল্লাহর ইবাদত কর! তিনি ছাড়া কোন ইলাহ নেই।”
শেষ নবী হযরত মুহাম্মদ সা. সম্পর্কে আল্লাহ বলেন, সূরা মায়িদা : ৬৭
يَا أَيُّهَا الرَّسُولُ بَلِّغْ مَا أُنْزِلَ إِلَيْكَ مِنْ رَبِّكَ وَإِنْ لَمْ تَفْعَلْ فَمَا بَلَّغْتَ رِسَالَتَهُ وَاللَّهُ يَعْصِمُكَ مِنَ النَّاسِ
‘‘হে রাসূল! তোমার প্রভুর পক্ষ হতে তোমার উপর যা কিছু নাজিল করা হয়েছে, তা লোকদের কাছে পৌঁছে দাও। তুমি যদি তা না কর, তাহলে তাঁর রিসালাতের দায়িত্ব পালন করবে না। লোকদের অনিষ্ট হতে আল্লাহই তোমাকে রক্ষা করবেন।
নবী-রাসূলগণের উত্তরসূরি হিসেবে দায়ী ইলাল্লাহ এ মহান কাজের আঞ্জাম দিবে। দায়ীরা রাসূল সা.-এর ওয়ারিশ আল্লাহর পথে দাওয়াতি কাজ করা নবী মুহাম্মদ সা.-এর কাজ, এ জন্যই তাকে এই পৃথিবীতে প্রেরণ করা হয়েছিলো। রাসূল সা.কে উদ্দেশ্য করে আল্লাহ বলেন, সূরা ইউসুফ : ১০৮
قُلْ هَذِهِ سَبِيلِي أَدْعُو إِلَى اللَّهِ عَلَى بَصِيرَةٍ أَنَا وَمَنِ اتَّبَعَنِي
“আপনি বলে দিন, এই আমার পথ। আমি ও আমার অনুসারীরা আল্লাহর দিকে বুঝে-শুনে দাওয়াত দেই।”
এ থেকে জানা যায়, একজন দায়ীকে নবী-রাসূলগণের উত্তরসূরি হিসেবে তাঁদের রেখে যাওয়া কাজকে আঞ্জাম দিতে সর্বদা ব্যস্ত থাকতে হবে।
হাদিসে জ্ঞানীদেরকে আম্বিয়াদের উত্তরসূরি হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে। যেমন- আবু দাউদ
إِنَّ الْعُلَمَاءَ وَرَثَةُ الأَنْبِيَاءِ
“আলেমগণ আম্বিয়াদের উত্তরসূরি।”
আল্লাহ তায়ালা স্বীয় নবী হযরত মুহাম্মদ সা.কে বলেন, সূরা হাজ্জ : আয়াত ৬৭
لِكُلِّ أُمَّةٍ جَعَلْنَا مَنْسَكًا هُمْ نَاسِكُوهُ فَلَا يُنَازِعُنَّكَ فِي الْأَمْرِ وَادْعُ إِلَى رَبِّكَ إِنَّكَ لَعَلَى هُدًى مُسْتَقِيمٍ
“আমি প্রত্যেক উম্মতের জন্য এক একটি নিয়ম-নীতি নির্ধারণ করেছি যা তারা পালন করেছে। অতএব, তারা যেন এ ব্যাপারে আপনার সাথে বিতর্ক না করে। আপনি তাদেরকে আপনার প্রভুর দিকে আহ্বান করুন। নিশ্চয়ই আপনি সরল ও সঠিক পথে আছেন।”
দায়ী ইলাল্লাহর কথা পৃথিবীর সবচেয়ে উত্তম আল্লাহর পথে দাওয়াত দানকারীর কথা কাজ এই পৃথিবীর মধ্যে সবচেয়ে উত্তম ও শ্রেষ্ঠ। কারণ দায়ীরা ইসলাম সম্পর্কে অশিক্ষিত ও মূর্খদেরকে দ্বীনের পথে আনার চেষ্টা করে। আর যে মূর্খদেরকে শিক্ষাদান করে, গাফিলদেরকে নসিহত করে, মানুষকে সঠিক ইবাদতের দিকে ডাকে তার কথার চেয়ে উত্তম কথা আর কারো হতে পারে না। এ সম্পর্কে আল্লাহ তায়ালা আল-কুরআনে বলেন, সূরা হা-মীম সাজদা : আয়াত ৩৩
وَمَنْ أَحْسَنُ قَوْلًا مِمَّنْ دَعَا إِلَى اللَّهِ وَعَمِلَ صَالِحًا وَقَالَ إِنَّنِي مِنَ الْمُسْلِمِينَ
“তার কথার চেয়ে কার কথা উত্তম, যে আল্লাহর দিকে দাওয়াত দেয়, সৎকর্ম করে এবং বলে, অবশ্যই আমি মুসলিমদের অন্তর্ভুক্ত?”
সহীহ বুখারী হাদিস নং-৩৪৬১
عَنْ عَبْدِ اللهِ بْنِ عَمْرٍو أَنَّ النَّبِيَّ صلى الله عليه وسلم قَالَ بَلِّغُوْا عَنِّيْ وَلَوْ آيَةً وَحَدِّثُوْا عَنْ بَنِيْ إِسْرَائِيْلَ وَلَا حَرَجَ وَمَنْ كَذَبَ عَلَيَّ مُتَعَمِّدًا فَلْيَتَبَوَّأْ مَقْعَدَهُ مِنْ النَّارِ
আবদুল্লাহ ইবনু ‘আমর (রাঃ) হতে বর্ণিত। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, আমার কথা পৌঁছিয়ে দাও, তা যদি এক আয়াতও হয়। আর বনী ইসরাঈলের ঘটনাবলী বর্ণনা কর। এতে কোন দোষ নেই। কিন্তু যে কেউ ইচ্ছে করে আমার উপর মিথ্যারোপ করল, সে যেন জাহান্নামকেই তার ঠিকানা নির্দিষ্ট করে নিল।
দাওয়াত দুই প্রকার
১। দাওয়াতে ইলাল্লাহ
২। দাওয়াতে ইলাশায়তন
সূরা নিসা : আয়াত ৭৬
اَلَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡا یُقَاتِلُوۡنَ فِیۡ سَبِیۡلِ اللّٰهِ ۚ وَ الَّذِیۡنَ كَفَرُوۡا یُقَاتِلُوۡنَ فِیۡ سَبِیۡلِ الطَّاغُوۡتِ فَقَاتِلُوۡۤا اَوۡلِیَآءَ الشَّیۡطٰنِ ۚ اِنَّ كَیۡدَ الشَّیۡطٰنِ كَانَ ضَعِیۡفًا
যারা মুমিন তারা আল্লাহর পথে যুদ্ধ করে, আর যারা কাফের তারা তাগূতের পথে যুদ্ধ করে। কাজেই তোমরা শয়তানের বন্ধুদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ কর; শয়তানের কৌশল অবশ্যই দুর্বল।
মুসনাদ আহমদ
عَن الحارِثِ الْأَشْعَرِىِّ قَالَ : قَالَ رَسُوْلُ اللّٰهِ ﷺ :«اٰمُرُكُمْ بِخَمْسٍ : بِالْجَمَاعَةِ وَالسَّمْعِ وَالطَّاعَةِ وَالْهِجْرَةِ وَالْجِهَادِ فِىْ سَبِيلِ اللّٰهِ وَإِنَّه مَنْ خَرَجَ مِنَ الْجَمَاعَةِ قِيدَ شِبْرٍ فَقَدْ خَلَعَ رِبْقَةَ الْإِسْلَامِ مِنْ عُنُقِه إِلَّا أَنْ يُرَاجِعَ وَمَنْ دَعَا بِدَعْوَى الْجَاهِلِيَّةِ فَهُوَ مِنْ جُثٰى جَهَنَّمَ وَإِنْ صَامَ وَصَلّٰى وَزَعَمَ أَنَّه مُسْلِمٌ». رَوَاهُ أَحْمَدُ وَالتِّرْمِذِىُّ
হজরত হারিস আল-আশআরী (রাঃ) হতে বর্ণিত, রাসূল (সঃ) বলেছেন, আমাকে পাঁচটি বিষয়ের আদেশ দেয়া হয়েছে। আমিও তোমাদেরকে পাঁচটি বিষয়ের নির্দেশ দিচ্ছি। তাহলঃ (১) জামায়াতবদ্ধ জীবন, (২) নেতার আদেশ শোনা, (৩) নেতার আদেশ মানা, (৪) ইসলামের প্রয়োজনে হিজরত করা এবং (৫) আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ করা। যে জামায়াত থেকে এক বিঘত পরিমাণ সরে গেল সে তার গলা থেকে ইসলামের রশিটা সরিয়ে ফেললো। যতক্ষণ না সে আবার জামায়াতবদ্ধ জীবনে ফিরে আসে। আর যে জাহিলিয়াতের দিকে মানুষকে আহ্বান করে তাকে জাহান্নামের খড়ি তৈরি করা হবে। সাহাবীরা জিজ্ঞেস করলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ (সঃ)! সে যদি নামাজ পড়ে ও রোজা রাখে? রাসূল (সঃ) বললেন, সে যদি নামাজ পড়ে, রোজা রাখে এবং নিজেকে মুসলমান বলে দাবি করে এর পরও সে জাহান্নামি।
ব্যাখ্যা
সূরা নাহল : আয়াত ১২৫
ادْعُ إِلَى سَبِيلِ رَبِّكَ بِالْحِكْمَةِ وَالْمَوْعِظَةِ الْحَسَنَةِ وَجَادِلْهُمْ بِالَّتِي هِيَ أَحْسَنُ إِنَّ رَبَّكَ هُوَ أَعْلَمُ بِمَنْ ضَلَّ عَنْ سَبِيلِهِ وَهُوَ أَعْلَمُ بِالْمُهْتَدِينَ (১২৫)
অনুবাদঃ তোমরা রবের পথে হিকমত ও সুন্দর উপদেশের মাধ্যমে আহ্বান কর এবং সুন্দরতম পন্থায় তাদের সাথে বিতর্ক কর। নিশ্চয়ই একমাত্র তোমার রবই জানেন কে তার পথ থেকে ভ্রষ্ট হয়েছে এবং হিদায়াতপ্রাপ্তদের তিনি খুব ভালো করেই জানেন।
এই আয়াতে দাওয়াতের জন্য তিনটি বিষয়ের প্রতি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে ।
১। হিকমাহ্
২। উত্তম আচারন
৩। বিতর্ক করা
১। হিকমাহ্
হিকমতের পরিচয় ‘হিকমাহ্’ একটি ব্যাপক অর্থজ্ঞাপক শব্দ। এর অর্থ তত্ত্বজ্ঞান, বিজ্ঞান, জ্ঞান, দর্শন, পরিণামদর্শিতা, বিচক্ষণতা এ শব্দটির মূল ধাতু حكم এর এর অর্থ আদেশ করা, শাসন করা, নিষেধ করা, বিরত রাখা, বিধিসমূহ পরিচালনা করা, আদেশ প্রবর্তন করা, মীমাংসা করা। আরবি ভাষায় حكيم শব্দটি ফায়সালাকারী এবং চিকিৎসকের অর্থেও ব্যবহার হয়। ইমাম ফখরুদ্দীন রাযী হিকমতের পরিচয় দিয়েছেন এভাবে, هي الإصابة في القول والفعل ووضع كل شيء موضعه “কথা ও কাজে সঠিক তথা যথাযথ এবং প্রত্যেকটি বিষয় বা বস্তুকে যথাযথ স্থানে রাখাকে হিকমত বলে।”
দাওয়াত দানে হিকমতের স্বরূপ উপযুক্ত অবস্থা অনুধাবন করে সময়, স্থান ও পরিবেশ বুঝে দাওয়াত উপস্থাপন করতে হবে। দাওয়াত বন্ধ করা যাবেনা। আমাদের দেশে অনেক লোক আছে যারা হিকমাহ এর কথা বলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রনে না থাকলে দাওয়াত বন্ধ করে দেয়, যা ইসলাম পরিপন্থী।
রাসুল সাঃ এর জীবনী থেকে একটি উদাহরন দেওয়া যেতে পারে
নবুওয়তের দশম বছর রাসুল স: দাওয়াতের জন্য তায়েফ গমন করেন। তার সঙ্গী ছিল যায়েদ ইবনে হারেসা রা:। তায়েফে তিনি প্রায় প্রত্যেক নেতাকে ইসলামের দাওয়াত দিয়েছেন তার দাওয়াতে কেউ সাড়া দেয়নি বরং ছোট বাচ্ছাদের তার পিছনে লেলিয়ে দিয়েছে। রাসুল স: ফিরার পথে বাচ্ছারা তাকে গালমন্দ ও পাথর ছুড়তে শুরু করে এতে তিনি ও যায়েদ ইবনে হারেসা রা: রক্তাক্ত হয়। অবশেষে তারা ওতবা, শায়বা এবং রবিয়াদের একটি বাগানে আশ্রয় নেয়। তিনি একটি আংগুর গাছের ছায়া বসে তাদের জন্য দোয়া করলেন। এরপর রবিয়ার পুত্ররা তাদের দাস আসাদের হাতে কিছু আংগুর নিয়ে রাসুল স: এর কাছে পাঠালেন তিনি বিসমিল্লাহ বলে তা খাওয়া শুরু করলেন। আসাদকে জিজ্ঞাসা করলেন তোমার বাড়ি কোথায়? সে বললো নিনোভায়। তখন রাসুল স: বললেন আপনি পূন্যশীল বান্দা ইউসুফ আ: এর এলাকার অধিবাসী। তাদের মধ্যে আরো কিছু কথা হলো। এবং আসাদ রাঃ এর কথায় মুগ্ধ হয়ে ইসলাম গ্রহন করেন। এরপর তিনি সেখান থেকে বের হয়ে মানায়েল নামক স্থানে আসার পর জিবরাইল আ: আসলেন এবং বললেন আপনি চাইলে তাদেরকে দুই পাহাড় দিয়ে পিষে দিবো। তখন রাসুল স: বললেন না। তাদের মধ্যে ভালো মানুষ আসবে যারা আল্লাহর ইবাদাত করবে।
আমরা হযরত নূহ (আ)-এর দাওয়াতেও একই হিকমত দেখতে পাই। তিনি গোপনে ও প্রকাশ্যে মানুষদেরকে আল্লাহর পথে ডাকতেন। আল্লাহ বলেন, সূরা নূহ : আয়াত ৮-৯
ثُمَّ إِنِّي دَعَوْتُهُمْ جِهَارًا ثُمَّ إِنِّي أَعْلَنْتُ لَهُمْ وَأَسْرَرْتُ لَهُمْ إِسْرَارًا
“তারপর আমি তাদেরকে প্রকাশ্যে আহ্বান করেছি। অতঃপর তাদেরকে আমি প্রকাশ্যে এবং অতি গোপনেও আহ্বান করেছি।”
দাওয়াতি ক্ষেত্রে প্রযুক্তির ব্যবহার জ্ঞান-বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ব্যবহার করে দাওয়াত উপস্থাপন করাকেও হিকমাহ এর অন্তর্ভুক্ত করা হয়। যেমন হযরত সোলাইমান (আ) সাবার রানীকে প্রযুক্তির ব্যবহার করে দাওয়াত দিয়েছিলেন। আল-কুরআনে বর্ণিত হয়েছে, সূরা নামল : আয়াত ৪৪
قِيلَ لَهَا ادْخُلِي الصَّرْحَ فَلَمَّا رَأَتْهُ حَسِبَتْهُ لُجَّةً وَكَشَفَتْ عَنْ سَاقَيْهَا قَالَ إِنَّهُ صَرْحٌ مُمَرَّدٌ مِنْ قَوَارِيرَ قَالَتْ رَبِّ إِنِّي ظَلَمْتُ نَفْسِي وَأَسْلَمْتُ مَعَ سُلَيْمَانَ لِلَّهِ رَبِّ الْعَالَمِينَ
“তাকে বলা হল, ‘প্রাসাদটিতে প্রবেশ কর’। অতঃপর যখন সে তা দেখল, সে তাকে এক গভীর জলাশয় ধারণা করল এবং তার পায়ের গোছাদ্বয় অনাবৃত করল। সুলাইমান বলল, ‘এটি আসলে স্বচ্ছ কাঁচ-নির্মিত প্রাসাদ’। সে বলল, ‘হে আমার রব, নিশ্চয় আমি আমার নিজের প্রতি যুলুম করেছি। আমি সুলাইমানের সাথে সৃষ্টিকুলের রব আল্লাহর নিকট আত্মসমর্পণ করলাম’।”
এভাবে দায়ী ইলাল্লাহগণ পরিবেশ-পরিস্থিতি অনুধাবন করে জ্ঞান-বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ব্যবহার করে মানুষের কাছে ইসলামের সুমহান আদর্শের দাওয়াত পৌঁছে দেবে।
২। উত্তম আচারন
দাওয়াতি ক্ষেত্রে মাওইযাতুল হাসানাহ-এর অনুসরণ দায়ীকে মাওয়েজাতুল হাসানা পদ্ধতির অনুসরণ করার মাধ্যমে বিরোধী শক্তিকে মোকাবেলা করা সম্ভব। ইসলামী দাওয়াতের এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম। এ পদ্ধতি অবলম্বনের মাধ্যমে দাওয়াহ দ্রুত সম্প্রসারণ সম্ভব। এ আয়াতে হিকমত অবলম্বনের পরই মাওয়েযা হাসানা অবলম্বনের কথা বলা হয়েছে। ‘মাউইযা’ শব্দটি আভিধানিক দিক দিয়ে বিভিন্ন অর্থে ব্যবহৃত হয়। যথা- তায্কির বা স্মরণ করানো। এর আর একটি অর্থ হচ্ছে নসিহতের সুরে স্মরণ করিয়ে দেয়া, কেউ কেউ একে নেক কাজের আদেশ দেয়া, ভীতি প্রদর্শন করা অর্থ বুঝিয়েছেন। ‘হাসানা’ অর্থ ভালো, সুন্দর, মাধুর্যময়। আল-মাউইযাতুল হাসানার সংজ্ঞা দিতে গিয়ে আল্লামা বায়যাভী বলেন, “মাউইযাতুল হাসানা হল তুষ্টি ব্যক্তিক বক্তৃতামালা ও উপকারী বা কার্যকরী শিক্ষণীয় ও দৃষ্টান্তমূলক বিষয়সমূহ।”
বিরোধী শক্তির মোকাবেলায় দাওয়াতের এ পদ্ধতি অত্যন্ত উপাদেয়। বন্ধুত্বপূর্ণ নরম ব্যবহার, সাবলীল ভাষা ব্যবহার, শান্ত-শিষ্ট ও ধীর স্থির চিত্তে মাউইযা আল-হাসানা উপস্থাপন মাদউ-এর মনকে দাওয়াত গ্রহণে সহযোগিতা করে। উত্তম ব্যবহার, সুন্দর আচরণ একজন মাদউর মনমগজকে দাওয়াত গ্রহণের উপযোগী করে গড়ে তোলে। এ জন্য দায়ী কখনো ভালোর বিপরীত কাজ করতে পারে না। এ সম্পর্কে আল্লাহ বলেন, সূরা হা-মীম সাজদা : আয়াত ৩৪
وَ لَا تَسۡتَوِی الۡحَسَنَۃُ وَ لَا السَّیِّئَۃُ ؕ اِدۡفَعۡ بِالَّتِیۡ هِیَ اَحۡسَنُ
“আর ভালো ও মন্দ সমান হতে পারে না। মন্দকে প্রতিহত কর তা দ্বারা যা উৎকৃষ্টতর,
৩। বিতর্ক করা
দাওয়াতি ক্ষেত্রে মুজাদালা অবলম্বন করা উক্ত সুরা নহলের ১২৫ নং আয়াতের সর্বশেষ বলা হয়েছে, وَجَادِلْهُمْ بِالَّتِي هِيَ أَحْسَنُ “তোমরা ঝগড়া-বিবাদের সময় উত্তম পন্থা অবলম্বন করবে।” আয়াতের এ অংশ থেকে জানা যায়, ইসলামী দাওয়াতের ক্ষেত্রে একজন দায়ী মুজাদালা বা ঝগড়া-বিবাদ করতে পারবে, এটা মানুষের কাছে ইসলাম প্রচারের একটি গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম। তবে যদি ঝগড়া-বিবাদ বাধে সে ক্ষেত্রে উত্তমপন্থা অবলম্বন করতে হবে। আরবি মুজাদালা শব্দের অর্থ: পারস্পরিক আলোচনা এবং যুক্তি প্রমাণের মাধ্যমে বিতর্কমূলক মত বিনিময়।
দাওয়াত প্রচারে বিরোধী শক্তির মোকাবেলায় এটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। এ পদ্ধতি অবলম্বনে পবিত্র কুরআনের প্রত্যক্ষ নির্দেশ রয়েছে। এ সম্পর্কে মহান আল্লাহ বলেন, সূরা আনকাবুত : আয়াত ৪৬
وَلَا تُجَادِلُوا أَهْلَ الْكِتَابِ إِلَّا بِالَّتِي هِيَ أَحْسَنُ
“তোমরা উত্তম পন্থা ব্যতীত আহলে কিতাবদের সাথে বিতর্ক করবে না।”
নবী-রাসূলগণ, সাহাবি, তাবেয়ি পরবর্তীকালে সালফেসালিহিনগণ এ পদ্ধতি অনুসরণ করতেন। প্রতিপক্ষের চিন্তাধারা বিশ্বাস প্রমাণ খন্ডনে এ পদ্ধতিটির গুরুত্ব অনস্বীকার্য। এ পদ্ধতি অবলম্বন করার মাধ্যমে বিরোধী শক্তির মোকাবেলা করে ইসলামের সুমহান আদর্শের দাওয়াত সহজেই মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়া যায়।
শিক্ষা
১. দাওয়াতি কাজ করা ফরজ তাই এটাকে জীবনের মিশন হিসেবে নিতে হবে।
২. দাওয়াতকে ফলপ্রসূ করার জন্য হিকমত অবলম্বন করতে হবে এবং মাওয়েজা আল-হাসানার মাধ্যমে দাওয়াত উপস্থাপন করতে হবে।
৩. যদি ইসলামের স্বার্থে বিতর্কের প্রেক্ষাপট সৃষ্টি হয় সে ক্ষেত্রে সর্বোত্তম পন্থা অবলম্বন করতে হবে। আল্লাহ আমাদের তৌফিক দিন। আমিন।