Thursday , April 25 2024

মীলাদুন্নবী (ﷺ) উদযাপন করা কখন শুরু হয়েছে?

মীলাদুন্নবী এর সংবিধিবদ্ধ সতর্কীকরণ।

হে মুসলিম ভাই আপনি কি জানেন⁉

মীলাদুন্নবী (ﷺ) উদযাপন করা কখন শুরু হয়েছে?

❌ জাল বইয়ের জাল হাদীস
হিজরী দশম শতকের প্রসিদ্ধ আলেম ইবন হাজার হাইতামী মাক্কী (৮৯৯-৯৭৪/১৪৯৪-১৫৬৬ হি)-এর নামে তুরস্কের মাকতাবাতুল হাকীকাহ নামক একটি প্রকাশনা সংস্থা গত ১৯৯৩ খৃ (১৪১৪ হি) ‘‘আন-নি’মাতুল কুবরা আলাল আলাম ফী মাওলিদি সাইয়িদি ওয়ালাদি আদাম’’ (বিশ্বের উপর শ্রেষ্ঠ নিয়ামত আদম সন্তানদের নেতার জন্মের মধ্যে) নামে একটি বই প্রকাশ করেছে। এ বইটির মধ্যে মীলাদের পক্ষে সাহাবীগণের নামে অনেকগুলো সনদ বিহীন জাল হাদীস উল্লেখ করা হয়েছে। এ জাল বইটির প্রথম অধ্যায় নিম্নরূপ:⤵

❌‘‘প্রথম পরিচ্ছেদ মীলাদুন্নবী (ﷺ)-এর মর্যাদা বর্ণনায়। আবু বকর সিদ্দীক (রাঃ) বলেন, যে ব্যক্তি মীলাদুন্নবী পাঠের জন্য এক দিরহাম ব্যয় করবে সে জান্নাতে আমার সাথী হবে।

উমার (রাঃ) বলেন: যে ব্যক্তি মীলাদুন্নবীর তা’যীম করবে সে ইসলামকে জীবিত করবে।

উসমান (রাঃ) বলেন: যে ব্যক্তি মীলাদুন্নবী পাঠের জন্য এক দিরহাম ব্যয় করবে সে যেন বদর বা হুনাইনের যুদ্ধে যোগদান করলো। আলী (রাঃ) বলেন: ‘‘যে ব্যক্তি মীলাদুন্নবীর তা’যীম করবে এবং মীলাদুন্নবী পাঠের কারণ হবে, সে দুনিয়া হতে ঈমানের সাথে মৃত্যুবরণ করবে এবং বিনা হিসাবে জান্নাতে প্রবেশ করবে। হাসান বসরী (রাহ) বলেন: আমার কামনা হয় যে, যদি আমার উহদ পাহাড় পরিমাণ স্বর্ণ থাকত তবে আমি তা মীলাদুন্নবী পড়ার জন্য ব্যয় করতাম।


❌ ইমাম শাফিয়ী (রহ) বলেন: যদি কেউ মীলাদুন্নবীর জন্য বন্ধুদেরকে জমায়েত করে, খাবার প্রস্ত্তত করে, স্থান খালি করে দেয়, দান-খয়রাত করে এবং তার কারণে মীলাদুন্নবী পড়া হয় তবে কিয়ামতের দিন আল্লাহ তাকে সিদ্দীক, শহীদ ও সালিহগণের সাথে উত্থিত করবেন এবং সে জান্নাতে থাকবে।…’’

এভাবে আরো অনেক তাবিয়ী, তাবি তাবিয়ী ও পরবর্তী বুজুর্গগণের নামে মীলাদুন্নবী ‘পড়া’-র ফযীলতে অনেক বক্তব্য উল্লেখ করা হয়েছে। আমরা এখানে দুটি বিষয় আলোচনা করব:


১. বইটি ইবন হাজার হাইসামীর নামে একটি জাল বই এবং
২. এ সকল হাদীস ও বক্তব্য সবই নির্লজ্জ জালিয়াতদের বানানো মিথ্যা কথা।
নিম্নের বিষয়গুলো লক্ষ্য করুন:
❌(ক) আল্লামা ইবনু হাজার হাইতামীর পুরো নাম: আহমাদ ইবন মুহাম্মাদ ইবন মুহাম্মাদ ইবন হাজার শিহাবুদ্দীন মাক্কী শাফিয়ী। তিনি মীলাদুন্নবী উদযাপন ও মীলাদ পালনের সমর্থক ছিলেন। মীলাদুন্নবী বিষয়ক তাঁর রচিত একটি গ্রন্থের নাম ‘‘ইতমামুন নি’মাতিল কুবরা আলাল আলাম বিমাওলিদি সাইয়িদি ওয়লাদি আদাম’’, সংক্ষেপে: ‘আন-নি’মাতুল কুবরা’। গ্রন্থটি প্রসিদ্ধ। বিগত ৪০০ বৎসরে অনেক আলিম এ গ্রন্থের উদ্ধৃতি প্রদান করেছেন এবং গ্রন্থটির অনেক পান্ডুলিপি বিশ্বের বিভিন্ন গ্রন্থাগারে বিদ্যমান।

?এখানে আরব বিশ্বের কয়েকটি গ্রন্থাগার ও পান্ডুলিপি নম্বর উল্লেখ করছি। ইরাকের সুলাইমানিয়া প্রদেশের ওয়াকফ গ্রন্থাগার (মাকতাবাতুল আওকাফ), নং ১৩/৪৫৬-আইন এবং পান্ডুলিপি নং তা/মাজামী/২১৫-২১৮। সৌদি আরবের রিয়াদস্থ বাদশাহ ফয়সল গবেষণা কেন্দ্র, পান্ডুলিপি নং- ০২৬৩৩, ১৫২২-ফা-কাফ এবং পান্ডুলিপি বিষয়ক অধিদপ্তর, পান্ডুলিপি গ্রন্থাগার, নং ১৫৮৫, ৭০৩০, ১৪৪৬। মরক্কোর খাযানাতু তাতওয়ান গ্রন্থাগারে, পান্ডুলিপি নং ১৩/৪৫৬-আইন। ইয়ামানের সানআ শহরের বড় মসজিদের প্রাচীন গ্রন্থাগার: মাকতাবাতুল জামিয়িল কাবীর, পান্ডুলিপি নং ২২-মীম-জীম। সিরিয়ার দামেশক শহরের যাহিরিয়া গ্রন্থাগার, পান্ডুলিপি নং ৮৭২২, ৮১৬৪, ১১৩০১, ১১৩৪১, ৮৫৭১, ১১৩৬১, ৯৪৮৩, ৯৫৫৩। এ সকল পান্ডুলিপির ভিত্তিতে এ বইটি ইদানিং বৈরুত থেকে ছাপা হয়েছে।

❌(২) তুরস্কের মাকতাবাতুল হাকীকাহ প্রকাশিত ‘আন-নি’মাতুল কুবরা’ গ্রন্থটির সাথে এ সকল পান্ডুলিপির কোনোরূপ মিল নেই। বস্ত্তত বইটির কভারের নাম ও লেখকের নাম ছাড়া ভিতরের সবই জাল।

❌(৩) ‘আন-নি’মাতুল কুবরা’-র মূল পান্ডুলিপিগুলোর বক্তব্য নিম্নরূপ:⤵

‘‘আল্লাহর প্রশংসা করছি সকল পরিপূর্ণ প্রশংসা এবং তাঁর কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি সর্বোত্তম ও পূর্ণতম কৃতজ্ঞতা… মীলাদুন্নবী পালনের মূলভিত্তি বর্ণনা করার জন্য আমি একটি পুস্তিকা লেখার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলাম….। এটি লিখতে আমি উদ্বুদ্ধ হলাম তার কারণ মীলাদ পালনের মূলভিত্তি বিষয়ে মানুষেরা মতভেদ করেছে যে তা বিদআত কি না। আর গল্পকার বক্তা ও ওয়ায়িজগণ ব্যাপকভাবে জাল হাদীস এবং ভিত্তিহীন গল্প ও কবিতা বলছেন। তারা আল্লাহ এবং তাঁর রাসূল (ﷺ) থেকে একটুও লজ্জাবোধ করেন না- নির্লজ্জভাবে তাঁদের নামে মিথ্যা বলেন- কখনো ইচ্ছাকৃতভাবে এবং কখনো মুর্খতার কারণে। এজন্যই ইমামগণ বলেছেন: প্রত্যেক সচেতন ব্যক্তির জন্য ওয়াজিব দায়িত্ব হাত দিয়ে, জিহবা দিয়ে বা অন্তর দিয়ে এদের প্রতিবাদ করা।… প্রথম পরিচ্ছেদ মীলাদ পালনের মূল ভিত্তি বর্ণনার জন্য। ✔✔পাঠক জেনে রাখুন যে, মীলাদ পালন বিদআত; কারণ রাসূলুল্লাহ (ﷺ) যে তিন যুগের কল্যাণের সাক্ষ্য দিয়েছেন সে তিন যুগের সালফ সালিহীন কোনো ব্যক্তি থেকে এ কর্ম বর্ণিত হয় নি। তবে তা বিদআতে হাসানা বা ভাল বিদআত। কারণ এর মধ্যে অনেক ভাল কাজ অন্তর্ভুক্ত। যেমন দরিদ্রদের ব্যাপক কল্যাণ ও সহযোগিতা করা, কুরআন তিলাওয়াত করা, বেশি বেশি যিকর ও দরুদ পাঠ…..। ক্রুশের অনুসারী খৃস্টানগণ যদি তাদের নবীর জন্মের রাতকে সবচেয়ে বড় ঈদ হিসেবে গ্রহণ করতে পারে তবে এ কাজে ইসলামের অনুসারীদের অধিকার অধিকতর। …..।’’ ?[ইবন হাজার হাইতামী, আন-নি’মাতুল কুবরা (মিসরের জাতীয় গ্রন্থাগারে সংরক্ষিত পান্ডুলিপি, নং ৪৪৯) পৃষ্ঠা ১-৩।]

❌(৪) আমরা দেখছি যে, মূল ‘নি’মাতুল কুবরা’ গ্রন্থের প্রথমেই ইবন হাজার হাইতামী সুস্পষ্টভাবে ঘোষণা করছেন যে, সাহাবী, তাবিয়ী ও তাবি-তাবিয়ীগণের যুগের একজন মানুষও মীলাদুন্নবী পালনের কথা জানতেন না। খৃস্টান সম্প্রদায় ২৫ ডিসেম্বর যীশুখৃস্টের জন্মদিনকে বড়দিন বা ‘ঈদে মীলাদুল মাসীহ’ হিসেবে পালন করেন। বিশেষত ৫ম হিজরী শতকের শেষে ৪৯১ হি/ ১০৯৭ খৃ থেকে খৃস্টান ক্রুসেডারগণ সিরিয়া, ফিলিস্তিন, ইরাক ও মিসরের বিভিন্ন দেশ দখল করে খৃস্টান রাজ্য প্রতিষ্ঠা করে। এ সকল দেশে দখলদার খৃস্টানগণ মহাসমারোহে বড়দিন বা ‘ঈদে মীলাদুল মাসীহ’ পালন করতেন। বিষয়টি মুসলিমদেরকে ‘ঈদে মীলাদুন্নবী’ পালনের প্রেরণা দেয়। শতবর্ষ পরে ষষ্ঠ হিজরী শতকের শেষ প্রান্তে এসে মুসলিম সমাজও ঈদে মীলাদুন্নবী উদযাপন শুরু করে।

?পক্ষান্তরে জাল ‘নি’মাতুল কুবরা’ বইয়ের প্রথম পরিচ্ছেদের মূল বক্তব্য যে, খুলাফায়ে রাশেদীন সকলেই মীলাদ পালন করতেন এবং মীলাদ পালনকেই দ্বীনের সবচেয়ে বড় বিষয় বলে প্রচার করতেন। চার খলীফা যখন এভাবে মীলাদের মহাগুরুত্ব প্রচার করতেন তখন স্বভাবতই তাঁদের যুগের সকল সাহাবী-তাবিয়ী প্রতিদিনই মহাসমারোহে তা পালন করতেন!!

❌(৫) আলিমদের উদ্ধৃতিও জাল ‘নিমাতুল কুবরা’-র জালিয়াতি প্রমাণ করে। সীরাহ হালাবিয়্যাহর লেখক আল্লামা হালাবী (১০৪৪ হি), তাফসীর রুহুল বায়ানের লেখক আল্লামা ইসমাঈল হাক্কী (১১২৭ হি), ‘জা’আল হক্ক’ গ্রন্থের লেখক মুফতি আহমাদ ইয়ার খান প্রমুখ আলিম মীলাদের পক্ষে ইবন হাজার হাইতামী থেকে উদ্ধৃত করেছেন যে, তিনি তা বিদআতে হাসানা বলে উল্লেখ করেছেন। তিনি মীলাদের পক্ষে সাহাবী-তাবিয়ীগণ থেকে কোনো হাদীস উদ্ধৃত করেছেন বলে কেউই উল্লেখ করেন নি। পান্ডুলিপির বর্ণনায় রচিত গ্রন্থগুলোতেও উপরে উদ্ধৃত মূল পান্ডুলিপির বক্তব্য উদ্ধৃত করা হয়েছে।
?[হালাবী, আস-সীরাহ আল-হালাবিয়্যাহ ১/১৩৭; ?ইসমাঈল হাক্কী, রুহুল বায়ান ৯/২, ৪৭; ?ইসমাঈল পাশা বাবাতী বাগদাদী, ?ঈযাহুল মাকনূন ২/৬৬১; ?হাদিয়্যাতুল আরিফীন ১/৭৮; ?মুফতি আহমাদ ইয়ার খান, জা‘আল হক (অনুবাদ অধ্যাপক লুৎফুর রহমান, মোহাম্মদী কুতুবখানা, চট্রগ্রাম, ১৯৮৮), দ্বিতীয়াংশ ৩৯-৪০।]

❌(৬) এভাবে আমরা নিশ্চিত যে, মাকতাবাতুল হাকীকাহ প্রকাশিত এ বইটি ইবন হাজার হাইসামীর নি’মাতুল কুবরার নাম চুরি করে প্রকাশিত একটি জাল বই। তবে লক্ষ্যণীয় যে, এ জাল বইটি যদি জাল না হয়ে ইবন হাজার হাইতামী মাক্কী শাফিয়ীর নিজের লেখা বলে প্রমাণ হতো তাতেও এ গ্রন্থে উদ্ধৃত হাদীসগুলোর বিশুদ্ধতা প্রমাণ হতো না। ইবন হাজার মাক্কী শাফিয়ী তো দূরের কথা, স্বয়ং ইমাম মুহাম্মাদ ইবন ইদরীস মাক্কী শাফিয়ীও বা অন্য কোনো ইমাম, মুজতাহিদ, পীরানে পীর বা বুজুর্গও যদি এভাবে সনদবিহীন কোনো কথা উদ্ধৃত করেন তবে তা সনদ অনুসন্ধান ও যাচাই না করে কোনো মুসলিম কখনোই গ্রহণ করবেন না। ইমাম শাফিয়ী উদ্ধৃত অনেক হাদীস পরবর্তী শাফিয়ী ফকীহগণ দুর্বল বা জাল বলে প্রত্যাখ্যান করেছেন। হানাফী, মালিকী, হাম্বালী, কাদিরী, চিশতী, শাযিলী… সকল মাযহাব ও তরীকার আলিমগণ একই পদ্ধতি অনুসরণ করেছেন। প্রথম পর্বে আমরা এ সকল বিষয় আলোচনা করেছি।

❌(৭) রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ও সাহাবীগণের হাদীসের ভাষা, শব্দ ও পরিভাষা সম্পর্কে যার সামান্যতম জ্ঞান আছে তিনিও বুঝতে পারবেন যে, এগুলো সবই জাল কথা। কোনো ইংরেজি ডকুমেন্ট জাল করতে যেয়ে পানি খাওয়ার ইংরেজি (eating water), অথবা আরবী ডকুমেন্ট জাল করতে যেয়ে ‘‘নামায পড়া’’-র আরবী ‘‘قراءة الصلاة’’ লিখলে কোনো যাচাই ছাড়াই বুঝা যায় যে, ডকুমেন্টটি জাল এবং জালিয়াত একজন বাঙালী। তেমনি ‘মীলাদ পাঠের’ আরবী (قراءة المولد/ قراءة الميلاد) শুনলে কুরআন-হাদীসের আরবী বিষয়ে অভিজ্ঞ যে কেউ নিশ্চিত বুঝবেন যে, কথাটি কখনোই সাহাবীদের যুগের কারো কথা নয়; বরং সুনিশ্চিত জাল কথা এবং এ জালিয়াত তুর্কী বা তুর্কী যুগের তুর্কী ভাষা দ্বারা প্রভাবিত কোনো আরব জালিয়াত। ৬০০ হিজরীর দিকে মীলাদ উদযাপন শুরু হলে প্রথম কয়েক শত বৎসর একে (الاحتفال بالمولد) ‘মীলাদ উদযাপন, (عمل المولد) মীলাদ পালন ইত্যাদি বলা হতো। বিগত ২/৩ শত বৎসর যাবৎ মধ্যপ্রাচ্যে মীলাদ মাহফিলে মীলাদ বিষয়ক পুস্তিকা পাঠের প্রচলন হয়েছে। এজন্য বিগত ১/২ শত বৎসর যাবৎ মীলাদ অনুষ্ঠানকে অনেক সময় ‘‘মীলদুন্নবী পাঠ’’ বলা হয়। জালিয়াতগণ এ পরিভাষা ব্যবহার করেছেন।

About Abdul Latif Sheikh

Check Also

রাসুল (সাঃ) এর জীবনী

রাসুল (সাঃ) এর জীবনী সম্পর্কে সকলের জানা উচিত। বংশ পরিচয়ঃ রসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া আলেহি …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *